poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | নারীদেহ লোলুপ পুরুষ বারবার তোকে তার
শয্যায় নিয়েছে; তুই ভ্রষ্টা না কি ক্ষণিক প্রেমিকা-
এই বিচারের ভার নিতে পারব না। কেন তুই
হে নিঠুরা আমাকে কুরিয়ে ফেলে দিলি সার্জনের
ক্লিনিকে গোপনে? তোর নিজস্ব গুহায় ক্রমান্বয়ে
আমাকে সপ্রাণ বেড়ে উঠতে দিলি না? মা বলার
সাধ অঙ্কুরেই নষ্ট, আলো অন্ধকার আর বুক
ধুক ধুক করা খেলা নিয়ে হৈ হৈ জানতেই দিলি না।আমার তো বড়ো সাধ ছিল তোর গুহামুখ ঠেলে
এই রৌদ্রছায়াময় পৃথিবীতে বেরিয়ে আসার
সুতীব্র ঘোষণা দিয়ে। এ দুনিয়া কী-যে অপরূপ
শোভাময়, প্রাণের আনন্দমেলা চতুর্দিকে; সত্য
আছে দুঃখশোক, তবু কী-যে ভালো লাগে বেঁচে থাকা;
সবাই নির্দয় নয়, নয় শুধু ভ্রূণ হত্যাকারী। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | মাঝে-মধ্যে স্বপ্নে আমি মরুভূমি দেখি, মরুভূমি
অতিকায় তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠের মতো প্রসারিত আমার সত্তায়।
বিদীর্ণ বেহালা, ছিন্ন ভিন্ন বেশভূষা, মর্চে-পড়া
নীল পানপাত্র আর ঘোড়ার করোটি নিয়ে ধুধু বালিয়াড়ি
পড়ে থাকে; পশুরাজ নিঃসঙ্গ রাজার মতো করে বিচরণ-
জ্যোৎস্না তার দু’চোখে, কেশরে।
মরুভূমি ক্রমশ বিস্তৃত হয় স্বপ্নের ভেতরে, কখনো-বা
স্বপ্নটাই মরুভূমি। আমি,
স্বপ্ন, মরুভূমি একাকার মাঝে-মাঝে
আমার জীবন, যে-জীবন পিছনে এসেছি ফেলে বহুকাল আগে,
স্বপ্নের ভেতরে জ্বলে যেন মরীচিকা; বর্তমান নিরুদ্দেশ।
একটি বিশাল প্রাণীভূক পুষ্প আমাকে ভীষণ
আকর্ষণ করে,
তার অভ্যন্তরে চলে যেতে থাকি দ্রুত শোকগাথা
আওড়াতে আওড়াতে-
সেই পুষ্পটিকে বর্তমান বলে শান্ত করতে
ইচ্ছে হয়, ভবিষ্যত একজন অন্ধ উদাসীন
শিল্পীর মতন বালিয়াড়ি জুড়ে রবার বাজায়
এবং পায়ের কাছে তার
উটের কংকাল আর সাপের খোলস পড়ে থাকে।
মরুভূমি ক্রমাগত আমাকে করছে গ্রাস পৌরানিক প্রাণীর মতন
আর কী অবাক কাণ্ড ঘুমোতে গেলেই মনে হয়
শুয়ে আছি মরুর বালিতে,
মাথার উপরে কালো বৃশ্চিকের মতো সূর্য জ্বলে
এবং আমার ডান দিকে ফণিমনসার বন,
বাঁদিকে নিয়ত পলায়নপর মরুদ্যান। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | অভিশপ্ত নগরের ঠোঁট, শিরদাঁড়া, বুক ছুঁয়ে
হাওয়া বয়, কোট নড়ে। তপ্ত দু’টি চায়ের পেয়ালা
গেইশা নারীর মতো, কাকাতুয়া-ঝুটি কাঁপে, কালো
টেবিলে চামচ কথা বলে পিরিচের সঙ্গে, দূরে
গণিকার আলো-নেভা আস্তানায় বিষণ্ন নাবিক
অতিশয় ব্যবহৃত স্তনে হাত রেখে ঘন ঘন
নাক ডাকে, কুকুরের ক্রন্দন, পাড়ায় চৌদিদারি
হাঁকডাক ঝিমধরা নৈঃশব্দ্যকে ভীষণ অসুস্থ ক’রে তোলে।শব্দের গলিত শবে ব’সে টলমল
আকণ্ঠ করছে পান স্মৃতির কারণ-জল কোনো
পোড়-খাওয়া কাপালিক কবি। রাত্রি তাকে
কোন্ ফাঁকে বানায় আধার লেহনের? ফুল্কি ওড়ে দিগ্ধিদিক।দশদিকে ঢাকঢোল, খোল কর্তাল, ট্রাম্পেট, বাঁশি;
সমর্থিত রূপসীর মাথায় কাঁটার তাজ কিছু রঙ বাজ
পরিয়ে দিয়েছে, মাথা হেঁট। বিজ্ঞাপিত
সৌন্দর্যে গ্রহণ লাগে বুঝি,
পরমায়ু-পুঁজি কমে। টনক নড়ে না,
তার অঙ্কুশে কাতর জনকের ফসফুস-চেরা
রক্তের ঝলক পিকদানে ঘন ঘন,
ভগ্নীর আগুনে ঝাঁপ বিদেশ বিভুঁইয়ে; লগ্নহীন দিন যায়।হঠাৎ পুঁতির মালা দুলে ওঠে কিশোরীর,পুঁথিপাঠ, কবে
ঘাসফুলে বুলিয়ে আঙুল আর আঁচলে লুকিয়ে
কিছু কুল ঘরে ফেরে। ইদানীং রূপের খাঁচায় হাঁসফাঁস,
চন্দ্রকর অগ্নিকণা; কে তাকে বাঁচায় ডামাডোলে?টেকে না অস্থির মন ঘরে সারা দিনমান, সাঁঝ
আজকাল প্রায়শই শ্মশানের পুড়ন্ত শবের
উৎকট গন্ধের মতো, রাত্রির করুণ অপচয়।
কোনো কোনো রাতে লোকপ্রসিদ্ধ বোবায়
ধরে তাকে, মধ্যরাতে শিশু
জননীর বুকে
লগ্ন হ’তে ভয় পায়। সত্তায় কাঁপুনি, ব’সে থাকে
সারারাত; জেগে উঠে বিবাগী শয্যায় শুনি কার
কণ্ঠস্বর? জানালার কাছে
নারকেল গাছে হাওয়া ঢ’লে পড়ে সখীর ধরনে।
একটি রোরুদ্যমান মুখ
যেন কুয়াশার ফ্রেমে আঁটা।
কোথায় হলুদ বাটা? কুকারে চাপানো লাল মাংস?
মাঝে মাঝে উৎসবের আগে
বিউটি পার্লারে রূপচর্চা, কখনো বা মুখ্য কাজে
ধৈর্যচ্যুত, পাশা খেলে, পরাজিত দ্বন্দের সহিত
বারবার তামাশার বিপন্ন শিকার
হ’য়ে আত্মহননের আবৃত্তিতে মাতে। তার সাথে উতস্তত
পুরুষের খচরামি; যামিনী না যেতে চোরাবালি
ডাকে তাকে, বুঝি বা সৌন্দর্য ডোবে পরিত্রানহীন।প্রচণ্ড কর্কশ কবি ছুঁড়ে দ্যায় জোরদার লতা প্রাণপণে,
ব্যর্থতা সাপের মতো জড়ায় কেবলি
মহাক্রোশে তাকে, চেয়ে থাকে অসহায়;
ফোঁসে ক্রুর বালি; তবু হ্যাজাক নেভে না। ঝাঁক ঝাঁক
পাখি ডানা ঝাপ্টায়, চ্যাঁচায় মাঠ জুড়ে
উড়ে, আবার উঠুক ভেসে মাথা, হিলহিলে
সাপ দিক ঝাঁপ, গল্পগাথা সৃজনবিদিত হোক;
ক্লান্তকণ্ঠ, নাছোড় সাগ্নিক কবি পাক নব্য বাকের বিভূতি। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | হৈ হৈ হাটে কিছু কেনাকাটা কিংবা বেচা
ছিল না আমার মনে। তবু
ঘেঁষাঘেষি, পা মাড়ানো, গুঁতোগুঁতি আমাকে বিব্রত,
বিমর্ষ, বিপন্ন করে। কেউ কেউ রক্তের তিলক
কপালে পরিয়ে দেয়, কেউ বা পাঠায়
লাঠির অরণ্যে, হামেশাই গালি গালাজের বানে
ভাসি, আর কোমরবন্ধের নিচে খুশি
মেরে প্রতিপক্ষ সুখে পানসি ভাসায় নদীবক্ষে পাল তুলে।খুব সাবধানে তাঁবু খাটিয়ে নিজেকে নিরালায়
লুকিয়ে রাখার সাধনায় মগ্ন হই, ভালো থাকি
সূর্যমুখী-ছাওয়া মাঠে, গাছপালা, পাখিদের জলসায়, দিঘির স্নেহের
স্পর্শ নিয়ে, মাঝে মাঝে সাঁঝে দেখি একটি তরুণী
খোঁপা থেকে ফুল খুলে ভাষায় দিঘির জলে, চলে
যায় দিগন্তের দিকে। অন্য কারো পদচ্ছাপ দেখি না কখনো।অকস্মাৎ দুরন্ত ঝঞ্ঝায় এক ঝটকায় সুরক্ষিত
তাঁবু উড়ে যায়, খুঁটিগুলি শূন্যে ওড়ে,
দেবোপম উলঙ্গতা নিয়ে হি হি কাঁপি,
জলজ রাক্ষস তীক্ষ্ণ দাঁত দেখায়, কাচের মতো
ভাঙে প্রতিবোধ, চতুর্দিকে পুনরায়
হট্ররোল জেগে ওঠে; শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে থাকে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | “একটি স্বপ্নের পথে হেঁটে গিয়েছি সমুদ্রতীরে”,
বলে তুমি দিয়েছিলে স্বপ্নটির নিখুঁত বর্ণনা।
কী যে নাম সমুদ্রের ছিল না তোমার জানা, শুধু
ঝাউবীথি, গোধূলি, ক’জন ভদ্রলোক ছিল চেনা।একটি ঝিনুক তুমি দিলে বাড়িয়ে সবার হাতে
একে একে, হতশ্রী ঝিনুকটিকে ওরা দূরে ছুঁড়ে
ফেলে দিলো অবহেলে। সযত্নে কুড়িয়ে নিয়ে তার
বুক চিরে বের করি একটি অনিন্দ্য মুক্তো শেষে।দিনান্তে আমার করতলে মুক্তো দেখে সকলেই
বড় বেশি ঈর্ষাতুর হয়ে নাল ঠুকে বাঁকা চোখে
তাকালো আমার দিকে, তুমি আস্তে সুস্থে হেঁটে
দাঁড়াল আমার বাম পাশে। কনে-দেখা আলো চুমো
খেলো আমাদের, অকস্মাৎ তুমি হলে স্বয়ম্বরা-
মেতে থাকে পরস্পর বিবাহের অধিক বিবাহে। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি? হায়েনা রাত্রিকে
দাঁতে ছিঁড়ে হেসে ওঠে, পথে শত শত
ট্রাক থেকে উপচে পড়ে লাশ।
যারা বেঁচে আছে তারা সব
শবের মতোই, হয়তো বা ভস্মমূর্তি, টোকা দিলে
ঝ’রে যাবে, কোথাও বাতির চোখ নেই।
দুঃসময় ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে ছোটে ইতস্তত,
তার চাবুকের ঘায়ে আর্তনাদ করে এ শহর
বাংলার রূপসী নদী, গ্রাম, শস্যক্ষেত সমুদয়;
মেঘের কিনারা থেকে চুঁইয়ে পড়ে অবিরল বিষাদের জল
এবং সন্তানহারা জননীর মতো শোকস্তব্ধ মুখে আজও
ব’সে আছে রাত্রিদিন আমার এদেশ।
ভঙ্গুর দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে পঙ্গু আর অন্ধের মিছিল,
শহরে ও গ্রামে দীর্ঘ থেকে
দীর্ঘতর হয় বিভ্রান্তির বহুরূপী ছায়া, ক্রূর
শক্রদের হট্ররোল বাড়ে ক্রমাগত আর মিত্রেরা নিঃসাড়,
চন্দ্রাহত রেস্তোরাঁয় অসার বচসা,
অজ্ঞানতা গ্রাস করে দশ দিক; মূঢ়তার মেঘে
ঢাকা প’ড়ে যায়
অগণিত শহীদের মুখ।
ঘাতকেরা আমাকে খুঁড়তে বলে আমারই কবর,
সম্ভবত সুসময় দেখা আর হ’লো না আমার।
শহীদেরা আজ শুধু অসহায় নাম, যা এখন কেউ আর
আবৃত্তির যোগ্য বিবেচনা
করে না তেমন?
বুঝি তাই মধ্যরাতের নূর হোসেনের কবরের
সোঁদা মাটি ফুঁড়ে কান্নাপ্রায়
আওয়াজ বেরোয়া-
“তবে কেন আমার তরুণ বুকে হায়েনার দাঁত বিদ্ধ হ’লো
তবে কেন আমার স্বপ্নেরা আজ শেয়ালের মলে
মিশে যায় অবলীলাক্রমে?
তবে কেন হায় মুক্তিযুদ্ধ শকুনের চঞ্চুতে কয়েদি হয়?”
বাংলার কবি আমি নগণ্য, গরিব;
আহত আমার ডানা, উড়তে অক্ষম
মেঘলোক; আমার হৃদয় পড়ে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো পড়ে,
প্রিয় নূর, তোমার বুকের রক্ত নিরন্তর। আমার কবিতা
ভিজে ওঠে বার বার, ধুলো মুছে যায়,
স্বচ্ছ হয় পবিত্র চোখের মতো আর এবাদতে
আকাশকে ছোঁয়, পুনরায়
তোমার সাহসে জ্ব’লে ওঠে
আমার শব্দের পথে, বাড়ির কার্নিশে, নিসর্গের বুদোয়ারে,
তারুণ্যের বুকে, শুভ সমাবেশে অলৌকিক আলোর ভ্রমর। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | যখন তোমার কণ্ঠস্বর মঞ্জুরিত টেলিফোনে
সকালে দুপুরে রাতে, আশ্চর্য পুষ্টিত সেই স্বর
নিভৃতে আমার শরীরকে স্পর্শ করে, থর থর
অস্তিত্ব আমার কথাগুলো স্বপ্নময়তায় শোনে।
যদিও রয়েছে কিয়দ্দূরে, তবু এই গৃহকোণে
বসে তারবাহী কিছু কথা শুনে এ সামান্য ঘর
অলৌকিক অনন্য বাসরঘর হয়; অতঃপর
আমরা সঙ্গমসুখে ভাসি, নক্ষত্রেরা স্বপ্ন বোনে।টেলিফোনে আমাদের দু’জনের কথোপকথন
শেষ হলে আমার নিঝুম করোটিতে রয়ে যায়
দেবালয়ে গুণীর তানের মতো কিছু গুঞ্জরণ
বেলা অবেলায়, ঘাসবনে নিরিবিলি যুগ্মতায়
অবিরল বয়ে যাওয়া রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় ঝুলে থাকে
অসংবৃত টেলিফোন; চন্দ্রোদয়ে বিনিদ্র চকোর ডাকে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | আমার অভদ্র পদ্য পাৎলুন গোটানো, খালি পায়,
মধ্যবয়সের গাঢ় তামাটে রঙের
ছোপ নিয়ে গাঢ় শিস দিতে দিতে কুর্নিশ ছাড়াই
কুলীন ড্রইংরুমে ঢুকে পড়ে বলে,
‘আমাকে বসতে দিন চেয়ারে সোফায়। কঁচুমাচু, হাত জোড়
করে এক কোণে
দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি আয়ত্ত করিনি, সমাজের মধ্যমণি
আপনারা, জেনে
রাখুন, নাছোড় এই বান্দা। এখানে রয়েছে যারা
ধান্দাবাজ ফোঁপরদালাল সাধুবেশে
অসাধুর শিরোমণি, তাদের মুখোশ টেনে খুলে
ফেলবো নিমেষে আর আমার ঝাঁঝালো অট্রহাসি
ভীষণ কাঁপিয়ে দেবে মনোরম এ অট্রালিকার
ভিত আর হট্রগোলে
চকিতে করবো দাবি একান্ত আপনাদের শত
সুন্দরীর রঙিন চুম্বন, প্রাণে তরঙ্গ-জাগানো আলিঙ্গন।
ন্যাকা, মিল, ন্যালাক্ষ্যাপা অনৃপ্রাস থেকে সাত হাত
দূরে সরে, কাঁদুনির পাক
থেকে মুক্ত হয়ে
আমার বেয়াড়া পদ্য ঘোরে রহস্যের আঁকাবাঁকা
ঘুপচি গলিতে, সদ্য জেগে-ওঠা চরে,
গা এলিয়ে দেয় অপসৃত দেয়ালের ঘরে, বিদ্বেষবিহীন
উদাসীন নির্বিঘ্নে কাটাতে
চায় দিন, কিন্তু তার নৈঃশব্দ্যের এলাকায় হাতবোমা ছুড়ে
কারা যেন তার তীব্র বসন্ত দিনের
স্বপ্নকে ভীষণ খোঁড়া করে দেয় আদিম আক্রোশে।
ক্ষতিপূরণের দাবি না তুলেই আমার অত্যন্ত জেদী পদ্য
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে গুলিবিদ্ধ বীরের ধরনে।
বকধার্মিকের দল বারবার তেড়ে আসে লাঠি
উঁচিয়ে আমার
অশিষ্ট পদ্যের দিকে পুড়িয়ে মারতে চায় দূর মধ্যযুগী
মনের বিকারে আর নাছোড় শিকারে মাতে তাকে
বন্য পশু ঠাউরে, অথচ
এই পদ্য বিবর্ণ জীনস্-পরা ঋষ্যশৃঙ্গ, প্রখর খরায়
বৃষ্টি নামানোর ব্রত নিয়ে
আসে জনপদে
তপস্যার কী রুক্ষ নির্জন ঘেরাটোপ ছেড়েছুড়ে। বৃষ্টি এলে
ফিরে যায় বাজিয়ে উদাস কণ্ঠে প্রত্যাবর্তনের আর্ত সুর
আমার অন্বেষাপরায়ণ পদ্য চৌদিকে বুলায়
চোখ, তার দৃষ্টিতে মৃত্যুর
বিষয়ে তেমন কৌতূহল নেই আপাতত, কেউ
তার ট্রাউজার, শার্ট থেকে শ্রমিকের ঘেমো
গন্ধ পায়, কেউ কেউ বনশিউলির, চন্দনকাঠের ঘ্রাণ।ত্রাণ শিবিরের এলেবেলে স্মৃতি নিয়ে
সূর্যাস্তের পরে
ঘরে ফেরে একা-একা ছটফট করে সারাক্ষণ, তারপর
বেরোয় রাত্রির পথে, হাঁটে,
সুদীর্ঘ আণ্ডারড্রেনে উজিয়ে বিষ্ঠার স্রোত মধুর বাজায়
পিতলের বাঁশি, যায়
কৃষ্ণাঙ্গ কবির সঙ্গে তাচ্ছিল্যে ফাঁসির মঞ্চে, চোখ
রাখে জল্লাদের চোখে। উত্তুরে হাওয়ায়, দোল-খাওয়া
কবির ছায়াকে ভালোবেসে
আমার এ ব্রাত পদ্য ছায়াপথে পর্যটক হয়। তার চোখে
তোমরা কখনো কেউ বইয়ে দিও না
সুদূর পারের অশ্রুনদী, কেননা নিশ্চিত জেনো,
এরপরেই তো জলে ধরবে আগুন। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি ;
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !
জীর্ণ দেয়ালের কানে বলি ;
দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে,
এই ইঁট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !
একজন বৃদেধের নিকট গিয়ে বলি, নতজানু,
হে প্রাচীন দয়া ক'রে দেবেন কি একটি কবিতা ?
স্তব্ ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠে - যদি
আমার মুখের রেখাবলী
তুলে নিতে পারো
নিজের মুখাবয়বে, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।
কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্যে
এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং
বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকবো কতোকাল ?
বলো কতোকাল ? |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | একজন ধার্মিক যেমন পবিত্র ধর্মগ্রন্থে অকুণ্ঠ বিশ্বাসী,
তেমনি আমিও বিশ্বাস অর্পণ করেছি
আমার প্রতি তোমার গভীর ভালোবাসায়।
এক মোহন, মজবুত সুতোয় গ্রথিত আমরা দু’জন;
আমরা যে-ঘর বানিয়েছি শূন্যের মাঝার
তার একটি ইটকেও খসাবার সাধ্যি নেই কোনো
জলোঠোসের কিংবা ভূমিকম্পের। আমরা পরস্পর
লগ্ন থাকব, যতদিন বেঁচে আছি।
এটাতো খুবই সত্যি আমাদের দু’জনের দেহ আলাদা,
কিন্তু অভিন্ন আমাদের হৃদয়, আমাদের কল্ব।আজকাল বহু রাত আমি জেগে কাটাই
সুফীর তরিকায়
আর এই নিশি-জাগরণই আমাকে জপিয়েছে,
গভীর নিশীথের নির্ঘুম প্রহরই আমাকে
তোমার নিবিড়তম সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে পারে।
নিদ্রার বালুচরে তোমার পদছাপ হারায় সহজে।
তাই আমি জেগে থাকব
প্রায়শ সারা রাত আর অবিরত
তোমার অস্তিত্ব আমার শিরায় শিরায় ফুটবে
অলৌকিক বুদ্বুদের মতো। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ‘আগুনে রেখেছো হাত, পুড়ে যাবে আপাদমস্তক’
ব’লে সে সাগ্নিকা কাঁপে ক্রমাগত দার্পিত আক্রোশে;
ঝরায় আগুন, মণিহারা সর্পিণীর মতো ফোঁসে।
দিইনি উত্তর কোনো, বোবা হ’য়ে ছিলাম নিছক।
এ কেমন রূপ মোহিনীর দেখে ফেলি আচানক?
অমন মধুর হাসি যার ঠোঁটে ক্ষণে ক্ষণে খেলা
করে, যাকে মমতার প্রতিমূর্তি ভাবি সারাবেলা
সে কেন উগরে দ্যায় কালকূট আজ অনর্থক?আসলে আমি কি ভন্ড, প্রতারক, অত্যন্ত পতিত?
কী এক বিভ্রমে ম’জে নিজেকেই করেছি শিকার
খেলাচ্ছলে; বুঝি তাই সময়ের কাছে প্রতারিত
এই আমি অকস্মাৎ হারিয়ে ফেলেছি স্বাধিকার।
সে-ও কি আমাকে ফেলে রক্তচক্ষু শক্রর দঙ্গলে
যাবে চ’লে নিতম্ব দুলিয়ে দূর গহীন জঙ্গলে? (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | এতকাল ছিলাম একা আর ব্যথিত,
আহত পশুর অনুভবে ছেঁড়াখোঁড়া।
দুর্গন্ধ-ভরা গুহাহিত রাত নিস্ফল ক্রোধে দীর্ণ,
শীর্ণ হাহাকার ছাড়া গান ছিল না মনে,
জানি প্রাণে ছিল না সতেজ পাতার কানাকানি
এমনকি মরম্নভূমির তীব্রতাও ছিল না ধমনীতে,
স্বপ্ন ছিল না,
ছিল না স্বপ্নের মতো হৃদয়।
কে জানতো এই খেয়ালি পতঙ্গ, শীতের ভোর,
হাওয়ায় হাওয়ায় মর্মরিত গাছ,
ঘাসে-ঢাকা জমি, ছায়া-মাখা শালিক
প্রিয় গানের কলি হয়ে গুঞ্জরিত হবে
ধমনীতে, পেখম মেলবে নানা রঙের মুহূর্তে।
কে জানতো লেখার টেবিলে রাখা বাসি রম্নটি
আর ফলের শুকনো খোসাগুলো
তাকাবে আমার দিকে অপলক
আত্মীয়ের মতো? |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | যখন দাঁড়াও তুমি রাত্তিরে কৃপণ বারান্দায়
নিরিবিলি, খোলা আকাশের তারাগুলি বিস্ফারিত
চোখে দ্যাখে তোমাকে এবং ভাবে-কে এই মানবী
এমন স্বর্গীয় রূপ নিয়ে আছে ধূসর জমিনে?
‘অতিশয়োক্তির অবকাশ নেই’, মেঘ তারাদের
কানে-কানে বলে। আমি মেঘ থেকে তৎক্ষণাৎ চোখ
সরিয়ে নক্ষত্রদের কৃতঞ্জতা জানাই আমার প্রেমিকার
উদ্দেশে প্রশস্তি রচনার জন্যে কৃপণ সমাজে।আমার প্রাণের কথা নক্ষত্র বলেছে অবিকল,
মনে মনে জানি আর যে যাই বলুক আমি তাকে
সবচে’ রূপসী ব’লে করি পান বিষণ্ন সৌন্দর্য
তার সঙ্গোপনে; উপরন্তু যার মনের বৈভব
সব বিবেচনাকে ছাপিয়ে ওঠে, তার কাছে রোজ
যাওয়া যায় সব বাধা, ঝড়জল হেলায় উজিয়ে। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এইমতো স্থিতি তার, স্পন্দনরহিত সর্বক্ষণ,
পতিত ফলের মতো ম্লান।
এভাবেই থাকে সে প্রায়শ
রাত্রিদিন এমন নিঃসাড়
পারিপার্শ্বিকের
প্রতি উদাসীন।টেলিফোন বাজে,
বেজে চলে ক্রমাগত বেলা অবেলায়;
পোস্টম্যান, বালকের রঙিন মার্বেল
অথবা উড়ন্ত ঘুড়ি, উদ্ভিন্ন মল্লিকা,
সোমত্ত গাছের
বাকলের ঘ্রাণ,
অকাল বৃষ্টির জুঁই-
কিছুই পারে না তার শিরায় জাগাতে কোনো গান।এভাবেই থাকে; রৌদ্র লাগে গালে, স্বেচ্ছাচারী জ্যোৎস্না
ধুয়ে দ্যায় মুখ, অথচ সে আপাতত
একটি খোলস শুধু।
সাংকেতিক ভাষার মতন
আছে স্থির সারাক্ষণ কণ্ঠস্বরহীন
এবং এখন কে বলবে করেছে সে
রোপণ বিস্তর
স্বপ্নবীজ ছন্নছাড়া মাঠে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া?
কে বলবে তার আঙুলের চকিত ছোঁয়ায় নারী
হয়ে যায় স্মরণীয় নিবিড় লিরিক?কোন ইন্দ্রজালে
সহসা খোলস ছিঁড়ে জেগে ওঠে অন্য একজন
কেমন সহজ ভঙ্গিমায়,
যেনবা বিপথগামী পথিকের ভালোয় ভালোয়
বেলাশেষে এক অনিবার্য ঘরে ফেরা। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | শহরে দুপুর ছিল, হৃদয়েও প্রখর দুপুর;
কে এক নবীন পাখি পাহাড়ের নিভৃতির ফুল,
সতেজ ঘাসের ঘ্রাণ, ঝর্ণার জলজ স্মৃতি নিয়ে
আমাদের দু’জনের ওপর ঝরালো বুনো সুর।তখন ছিল না মনে কী তোমার না, বিয়ে-টিয়ে
কখনো হয়েছে কি না, না কি তুমি সরল বিধবা!
আমাদের চতুর্দিকে বাংলা প্রজাপতি, দূর
আফ্রিকার ড্রামের সঙ্গীত; দেহমন রক্তজবা।সারা ঘরে তুমি রঙধনু, সমুদ্রের ঢেউ, দু’টি
মানুষের কী মধুর আলিঙ্গন অনন্তের পটে
আঁকা হয়ে যায় আর হৃৎপিণ্ডে গির্জার ঘন্টাধ্বনি;
আমরা দু’জন নীল স্বপ্ন হই, ফুল হ’য়ে ফুটে।যখন তোমাকে দেখি, মনে হয়, এই মাত্র তুমি
স্বপ্নের কোরক থেকে জন্ম নিয়ে দাঁড়িয়েছ পাশে
নবীনা, নতুন শিল্প সৃষ্টি হবে বলে। আমাদের
হৃদয়ের কান্না-ভেজা মাটি সে শিল্পের জন্মভূমি।তোমার কি মনে পড়ে সেই দুপুরের মাতলামি
কর্মময়তার কোনো ফাঁকে? যখন বারান্দা থেকে
বৃষ্টি দ্যাখো, তখন কি ভাবো বিগত-যৌবন এক
কবিকে নিঃসঙ্গতায় শরীর আহত স্বপ্নে ঢেকে? (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | বহুদিন ধ’রে ঢের পথে হেঁটে হেঁটে
প্রায় সন্ধেবেলা পৌঁছে যাই
কেমন আশ্চর্য স্থানে। জনমানবের
চিহ্ন নেই আশেপাশে কোনওখানে, কেবল তিনটি
কেমন আজব গাছ দাঁড়ানো বেজায়
উদ্ধত ধরনে, যেন এক্ষুনি কামড়ে খাবে বেখাপ্পা আমাকে।বৃক্ষদের রুক্ষ কণ্ঠস্বর আমাকে প্রবল ধাক্কা
দিয়ে উচ্চারিত হয়, ‘এখানে আসার
যোগ্যতা তোমার লাভ করার সুযোগ হয়েছে কি?
নাকি খেলাচ্ছলে ভুল ক’রে এই এলাকায় প্রবেশ করেছ!’কী জবাব দেব কিছু খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে চুপ
থাকা ছাড়া ছিল না উপায়। মাথা-ছোট
বালকের খেলারত মাথার ধরনে
বেজায় ঘুরতে থাকে যেনবা লাটিম। কিছুক্ষণ
পরে দেখি প’ড়ে আছি ধূসর মাটিতে। তা হ’লে কি
আমি মানুষের কোনও ধ্বংসলোভী জমিনের হয়েছি খোরাক?চকিতে পড়ল চোখে আসমানে চাঁদের, তারার
উল্লাস এবং প্রায়-মৃত আমার পাশেই একা
আছেন দাঁড়িয়ে বুজরুক দীর্ঘদেহী। তিনি গাঢ়
কণ্ঠস্বরে বললেন, “এখানে আসার জন্যে দেব না তোমাকে
অপবাদ। তবে বড় বেশি বিপদের ক্রূর ছায়া
এখানে কাঁপতে থাকে মৃত্যুর দুয়ার খুলে রেখো”।দৌড়বাজ পুরুষের ধরনে হঠাৎ ছুটে যাই
সামনের দিকে চোখ রেখে, দ্রুত হাওয়া
আমাকে পেছনে ঠেলে রাখতে বেজায়
বদ্ধপরিকর আর আমি শুধু ছুটছি, ছুটছি। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কেউ কেউ দ্যাখে দূর নীলিমায় ঝুলন্ত রেস্তোরাঁ।
কেউ কেউ সিঁড়িহীন সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় আর
প্রবাল-চেয়ারে বসে। এঞ্জেলের উজ্জ্বল পাখার
মতন টেবিলে আছে এটা সেটা আর মেঝে-জোড়া
অভ্রের কার্পেট। একদিন অপরাহ্নে আনকোরা
স্বপ্ন নিয়ে সেখানে ছিলাম আমরা, তুমি আর আমি-
আমার অধীর ওষ্ঠে চুম্বনে ছড়ালে অস্তগামী
সূর্যের সৌন্দর্য তুমি। ছিলো চাদ্দিকে নৈঃশব্দ্যে মোড়া।নীলিমায়বৃত সে রেস্তোরাঁয় কিছুক্ষণ পরে, শোনো,
হে দয়িতা, তুমি ছাড়া আর কিছুই পড়েনি চোখে;
সর্বব্যাপী শূন্যতায় তোমার গহন চক্ষুদ্বয়
যেন বা যমজ দ্বীপ-আমার নিবাস দুঃখ-শোকে
এবং আনন্দে চিরদিন। অকস্মাৎ কী-যে হয়
কাক-তাড়ুয়ার তীক্ষ্ম হাসি বুকে বাজে ঘন ঘন। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | সেদিন দুপুরে, নিরালায়, যা প্রান্তর, লীলায়িত সুনসান,
সহজে তোমাকে ছুঁতে পারতাম যে কোনো ছুঁতোয়।
তোমার আঙুলগুলো টেবিলের কাছে ফুটেছিল,
আমি সৌন্দর্যের ডাগরতা পারতাম ছুঁতে। তুমি
যে স্পন্দিত পাণ্ডুলিপি থেকে
জ্যোৎস্নাচর অক্ষরের পাখি, ঝাঁক-ঝাঁক,
কোমল দিচ্ছিলে ছেড়ে ক্রমাগত, আমি
তা পরখ করার ছলে
প্রথম তোমার করস্পর্শে শিহরিত
হতে পারতাম, হয়তো উঠতো ফুটে চকিতে আমার
নিজস্ব উদ্ভিন্ন অন্ধকারে
প্রথম কদম ফুল কিংবা বংশীধ্বনি হয়ে তোমার সত্তার
গহনে মিলিয়ে যেতে পারতাম, চোখে
চোখ রেখে করা যেতো হৃদয়ের আদি উচ্চারণ।
করিনি কিছুই। শুধু দেখেছি তোমাকে সে দুপুরে
হৃদয়ের মধ্যদিনে যতোটুকু দেখা যায়।
তুমিই যৌবন দেখি, দেখি
যৌবনে নদীর বাঁক আছে, আছে তরঙ্গ সকল
কূল-উপচানো, আর উড়ন্ত পাখির প্রিয় ডাক,
গহন আশ্বিন, অনাদৃত ফুলের বিস্ময়,
উদাসীন পথিকের দেশ-রাগাশ্রয়ী
গীত।ভরদুপুরকে নিমেষেই সন্ধ্যা ক’রে
তুমি চলে গেলে।
মাংসের দেয়ালে বাজে শত শত অশ্ব-ক্ষুরধ্বনি,
মাংসের ভেতরে ফোটে অনিদ্রার রক্তিম কুসুম,
মাংসের ভেতরে তিনজন অন্ধ গায়কের দীপকের তান,
মাংসের ভেতরে তীব্র স্পন্দিত বৈষ্ণব পদাবলি,
মাংসের ভেতরে কী মোহন বিস্ফোরণ,
মাংসের ভেতরে অবলুপ্ত খৃষ্ট-পূর্ব সভ্যতার জাগরণ!তুমিতো জানো না
যখন বিদায় নাও তুমি স্মিত হেসে,
ঔদাস্যে কখনো,
আমার ঘরের
যাবতীয় আসবাবপত্র
উড়ে চলে যায় দূরে। কেবল তোমার হস্তধৃত পাণ্ডুলিপি
গুণীর তানের মতো মধুর কাঁপতে থাকে ঘরে, বারে বারে
মনে হয়, সেই পাণ্ডুলিপি বিলি করবার লোভে
কে এক নাছোড়
স্মৃতিময় পোস্টম্যান বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সকল সময়
বন্দ ঘরে ভীষণ একাকি
গুজব রটনাকারী মানুষের মতো কিছু গল্প নিয়ে আমি
বসে থাকি শূন্যতায়, যেন বা অজ্ঞাতবাসে আছি। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | আমার মেয়েকে দেখি বাড়িটার আনাচে কানাচে
বেড়ায় আপন মনে, ফ্রক-পরা। খেলাঘরে তার
রকমারি খেলনা নিয়ে সকাল-বিকাল মেতে আছে।
দেখি রোজ ঘটা করে পুতুলের বিয়ে দেয় আর
ছোটায় কাঠের ঘোড়া তেপান্তরে, সমুদ্রে ভাসায়
সপ্তডিঙা। মায়ের গজ্ঞনা কিংবা পিতার নিষেধ
মানে না কিছুই, শুধু পুতুল-ভাঁড়ের তামাশায়
হাসে, নাচে ছড়ার ঘরোয়া ছন্দে, নেই কোনো খেদ।আমারও খেলার শখ আশৈশব, খলনার রূপক
স্বকালে করেছে ভিড়, তাই দৃশ্যান্তরে খলনাগুলি
কতিপয় শস্তা বুলি আর নষ্ট ধারণার ছক
মনে হয়। সংসার-জলার কাদা ঘেঁটে ছেঁকে তুলি
রঙচটা ভাঙা মূর্তি-মন আর বসে না খেলায়,
খেলনা ফেলে বসে থাকি নিরুপায় আজ অবেলায়। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | এ রকমই হয়, দিব্যি হয়ে আসছে অনেককাল থেকে।
যুগে যুগে গ্রাম ও শহর
বাদুড়ের পাখার মতন অন্ধকারে যায় ঢেকে
অকস্মাৎ। জাহাজের সম্পন্ন বহর
সন্ত্রস্ত বন্দর ছেড়ে ছোটে আর্তরবে
মধ্য-সমুদ্রের গাঢ় নীলিমায়, পারে না এড়াতে
ভরাডুবি; এরকমই হয়, বারবার হবে।দ্বৈপায়ন বণিক বেড়াতে
এসে দূর দেশে মশলার ঘ্রাণে গড়ে রাজ্যপাট।
দ্বিগ্ধিজয়ী বীরের অশ্বের পদাঘাতে চতুর্ধারে
ঘন ঘন ওঠে হাহাকার, নিমেষে উজাড় ত্রস্ত পথঘাট-
মড়কে এমনই হয়, সবাই পালায় ঊর্ধ্বশ্বাসে বনবাদাড়ে।অনেক শহর পোড়ে, ভাঙে গ্রাম, গ্রন্থের পাতায়
প্রমত্ত অশ্বের বিষ্ঠা জমে, খোঁড়া তৈমুর অথবা হিটলার
সবাই সোৎসাহে ক্রূর জামার হাতায়
নাচায় কংকাল, নগরের আগুনে তুমুল সেঁকে হাত আর
দেয় ছুঁড়ে অন্ধকূপে কিংবা গ্যাস চেম্বারে তাদের,
যারা কাড়া নাকাড়ার তালে রাজ-রাজড়ার সুরে
ওঠেনা যান্ত্রিক নেচে, বোঝে যারা কুটিলতা নানান ফাঁদের।
চিরকাল খেলা একই, পাল্টায় খেলুড়ে। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | প্লাটিনাম চোখ নিয়ে অজস্র শেয়াল রাত্রিভর
আমার বিছানা নোংরা করে স্বপ্নগুলো
দেয়ালে দেয়ালে ঝোলে সার্টিনের পর্দার মতন।
খুব হিংস্রতায়
একটি বিরাট কাঁচি সেসব পর্দার বুকে স্বেচ্ছাচারী হয়।
আফ্রিকার তিনটি মুখোশ অতি দ্রুত
কোরানের আয়াত আবৃত্তি
করতে করতে
আওড়ায় আদালতী বেবাক শপথ।আমি কি উম্মাদ হয়ে যাচ্ছি?ঘরে রাশি রাশি টেলিগ্রাম
অচল নোটের মতো নির্লজ্জ ছড়ানো ইতস্তত
এবং সকল বার্তা উদ্ধার-রহিত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে
দেখি মস্ত ছায়ার ধারালো জিভ চাটছে আমাকে
বিশদ ক্ষুধায়।
মেডুসার মুন্ডু চতুর্ধারে নেচে ওঠে বারংবার।
যোগাযোগহীন
টেলিফোন নিয়ে মেতে আছি, কেবলি ডায়াল করি
অসম্ভব ডিজিটের ঘোরে, নিঃশব্দতার ওপর করছি
অলৌকিক বলাৎকার
তবে কি বলবো, হায়, উন্মত্ততা বয়স্য আমার?এইতো মেঘের বুক ফুঁড়েহৃদয়দ্রাবক
তন্বী এক চারা অস্তিত্বের গরিমায় ঝলমলে,
অথচ হঠাৎ
একটি প্রকট হাত, সুবিশাল, দরজা-জানালা ছাদভেদী,
নেমে আসে আমূল উপড়ে নিতে, আমি সাত তাড়াতাড়ি
চারাটাকে মানবিক আড়ালে রাখতে চাই। সেই হাত আমাকে হেলায়
বারবার দিচ্ছে ছুঁড়ে, টেবিলের খাটের তলায়
গিয়েও নিস্তার নেই। সমগ্র সুন্দরবন আসে ঘর ব্যেপে,
চাক চাক আকাশও এখন
আমার নিবাসে, ভাসমান, ডাঁই ডাঁই সংবাদপত্রের নিচে
কেবলি তলিয়ে যাচ্ছি, একজন কাগজের মূর্তি, পিকাসোর
ছবির মতন কয়েকটি
মুখাবয়বের দীপ্র ব্যাপক চমক হেনে ডাকে,
টেবিলের দিকে ফুরফুরে আঙুল নিবন্ধ তার।ঘরময় ট্রেন দুর্ঘটনা, লঞ্চ ডুবি, জুয়োর টেবিল; অকস্মাৎ
আমার ডবল এসে আমাকেই পরায় লোহার হাতকড়ি,
চতুষ্পার্শে সুর্যমুখী, নতুন বাছুর, গয়লানী সাঁতরাচ্ছে,
শুধু সাঁতরাচ্ছে……
আমি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি? (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যা বসে থাকি তীব্র প্রতীক্ষায়,
বস্তুত অপেক্ষমাণ আমার নিজস্ব গৃহকোণ
সারা দিনমান, কান পেতে থাকি, হয়তো টেলিফোন
এখুনি উঠবে বেজে ঘরময় কালো স্তব্ধাতায়।
নিবদ্ধ আমার দৃষ্টি শাদা ধূসর খরগোশ-প্রায়
যন্ত্রটির গায়ে, ওর এই অন্ধ নীরবতা মন
মেনে নিতে চায় না কিছুতে। বুঝি তাই সারাক্ষণ
বলো কিছু বলো, বলে চেঁচাই শব্দের সাহারায়।টেলিফোন হার্দ্য বেজে উঠলেই হয়তো কোন্ দূর
দেশ থেকে (নাবিকের গান-ঝলসিত দ্বীপ?) ভেসে
আসবে, ঝরবে হৃদয়ের কানে তোমার মধুর
কণ্ঠস্বর, নিরন্তর মনে হয় স্তব্ধ মধ্যরাতে
এইতো উঠেছে বেজে, টেলিফোন আমার উদ্দেশে,
কিন্তু ভুল শুনি আর কষ্ট পাই নিঃশব্দ সংঘাতে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | রূপক |
শামসুর রাহমান | রূপক | প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যা বসে থাকি তীব্র প্রতীক্ষায়,
বস্তুত অপেক্ষমাণ আমার নিজস্ব গৃহকোণ
সারা দিনমান, কান পেতে থাকি, হয়তো টেলিফোন
এখুনি উঠবে বেজে ঘরময় কালো স্তব্ধাতায়।
নিবদ্ধ আমার দৃষ্টি শাদা ধূসর খরগোশ-প্রায়
যন্ত্রটির গায়ে, ওর এই অন্ধ নীরবতা মন
মেনে নিতে চায় না কিছুতে। বুঝি তাই সারাক্ষণ
বলো কিছু বলো, বলে চেঁচাই শব্দের সাহারায়।টেলিফোন হার্দ্য বেজে উঠলেই হয়তো কোন্ দূর
দেশ থেকে (নাবিকের গান-ঝলসিত দ্বীপ?) ভেসে
আসবে, ঝরবে হৃদয়ের কানে তোমার মধুর
কণ্ঠস্বর, নিরন্তর মনে হয় স্তব্ধ মধ্যরাতে
এইতো উঠেছে বেজে, টেলিফোন আমার উদ্দেশে,
কিন্তু ভুল শুনি আর কষ্ট পাই নিঃশব্দ সংঘাতে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | https://www.bangla-kobita.com/shamsurrahman/telefon/
2020-06-01T20:23:02.026040 |
শামসুর রাহমান | সনেট | একজন মৃতদেহ পানপাত্রে তিনটি হীরক
হেলায় দিলেন ছেড়ে। পানপাত্র থেকে আস্ত পরী
তিনজন অকস্মাৎ উপচে পড়লো, কালো তরী
হলো সাড়া ঘর, জলদস্যুর দুচোখ খুব ধ্বক
করে জ্বলে ওঠে, মৃতদেহটির সবগুলি নখ
বেড়ে বেড়ে অতিকায় ঈগলের চঞ্চু, নীল ঘড়ি
সোনাটার মতো বাজে, কজন কংকাল চূর্ণ জরি
মুখোর গহ্বরে পরে গান গায়, এসো হে মড়ক।একটি ঘাসের মূর্তি, তুর্কী টুপি-পরা, ঘূর্ণি নাচে
মত্ত, মৃতদেহটিকে ঘিরে তীব্র গাইছে কাসিদা,
আরক করছে পান খৃষ্টপূর্ব পিপের ভেতরে
ডুবিয়ে সবুজ মাথা, সাপ দীর্ঘ বাজে দগ্ধ গাছে
বোগাদাদী বণিকের তোরঙ্গ গচ্ছিত থরে থরে
কতিপয় মৃত সুন্দরীর চোখ, চোখে তীক্ষ্ম দ্বিধা। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কতিপয় হত্যাকারী, অতিশয় নিষ্ঠাবান, কেউ কানে খাটো,
একচুক্ষ কেউ,
কেউ বা ঈষৎ খোঁড়া, প্রাচীন ছোরার মতো কেউ,
রাত্রিদিন ঘোরেচারদিকে নানা ছদ্মবেশে
আমার প্রকৃত স্বপ্ন হননের জন্মন্ধ লিপ্সায়।
ওদের সান্নিধ্যে ওড়ে দুর্মর বাদুড় শত শত,
ওদের নিঃশ্বাসে বয় আজরাইলের
তিমির নিশ্বাস।
নগর পোড়াতে পারে ওরা, পারে হওয়ায় উড়িয়ে দিতে
গ্রামের সকল ঘাস, সহজে বানাতে পারে হাজার হাজার
বস্তিকে বিধ্বস্ত গোরস্থান।নরখাদকের মৃত্যু দেখি অধুনা সর্বত্র, দেখি
ওরা দ্বিধাহীন
প্রকাশ্যে সাজিয়ে রাখে লাশ,তামস ভঙ্গিতে
আমাকে আহার করে চেটেপুটে, আমার ভগ্নাংশ
থাকে পড়ে এক কোণে, মাথাটা অভুক্ত থাকে শুধু
এবং নিজেকে মনে হয়
পরাস্ত দেশের মতো অত্যন্ত ধোঁয়াটে,
হাহাকারময়, স্বপ্ন চেয়ে থাকে আমার উদ্দেশে
উপদ্রুত মানুষের মতো।আমার স্বপ্নের আছে ঘুরঘুট্রি আঁধারের ভয়,
আমার স্বপ্নের আছে রাতে পোকামাকড়ের ভয়,
মাটির তলায় নিত্য জিন্দা দাফন হবার ভয়
আমার স্বপ্নের ভয়, যদি
সহসা সাতায়
বাজ ভেঙে পড়ে,
ব্যাধের ফাঁদের ভয় আমার স্বপ্নের অহর্নিশ।
মাইল মাইলব্যাপী জনমান্ধের ভিড়ে
আমার আপন স্বপ্ন ভয়ে
কাঠ হয়ে থাকে।
কিছু স্বপ্ন, যতদূর জানি,
আকাশে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেই
চকিতে মিলিয়ে যায় আলোয় হাওয়ায়,
অশত্থ গাছের নিচে মেতে ওঠে আত্মহননের নান্দীপাঠে,
কোনো কোনো স্বপ্ন ফের ফিনিক্সের মতো
জন্মন্তরলোভী,
বারবার ডানা ক্ষিপ্র ঝাপটায় সজীব, গান গায়
চেতনায়, বুঝি তাই হত্যাকারী স্ট্রাটেজি পাল্টায় প্রতিদিন।আমার স্বপ্নের নাম রেখেছি কখনো, পুনরায়
ভুলে গেছি শত ডামাডোলে, হট্ররোলে।
আমার অনেক স্বপ্ন শিরোনামহীন
কবিতার মতো রয়ে গেছে
এবং কখনো
ব্যর্থ মানুষের
চোখের পানির মতো ঝরে বারে-বারে রিক্ত ফুটপাতে,
নিদ্রাছুট আহত বালিশে।কখন যে কবে কোন সালে, খ্রিস্টপূর্ব কালে?-মনে মনে শুধু
একটি স্বপ্নের নাম রেখেছি শ্রীমতী আজ আর
মনেই পড়ে না।
সে স্বপ্ন, শ্রীমতী নাম্নী স্বপ্ন, একজন
সোনালি মাংসল স্থাপত্যের মতো জেগে থাকে।তপ্ত হত্যাকারীর দঙ্গলে,
মঙ্গলের চেয়েও অধিক ভয়ঙ্কর লোকালয়ে,
পাশব নিবাসে, আর বিপুল নৈরাশে
নিবিড় সৌন্দর্য তার আমার মুখের রেখাবলী
থেকে দুঃখ পান করে প্রহরে, প্রহরে…
আমি সে স্বপ্নের মমতার তটরেখা থেকে আর
কোনোদিন জাগতে চাই না।
সেখানে স্মৃতিরর চন্দ্রোদয়, কিংদন্তির মতো
সেখানে বসন্ত আসে বারেবারে; আবার পালিয়ে যায়, যাক; (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমি তো এখন দূরে, বহুদূরে চলে
যেতে চাই। যদি হেঁটে যেতে হয়, তবু
দ্বিধাহীন চলে যাবো। যদি ঘামে নেয়ে উঠি, তবু
থামাবো না গতি, বেপরোয়া যাত্রী আমি।এই যে হেঁটেছি ইতিমধ্যে ঢের পথ, বাধা পেয়ে
যাইনি ভড়কে কিছুতেই। প্রধানত
আলোয়, অথচ ঘোর অমাবস্যা হলেও যাত্রার
বেগ না থামিয়ে চালিয়েছি পদযুগল
সামনের দিকে আর যখন হঠাৎ হিংস্র কোনও
পাখি এসে হামলা করেছে, ওকে দিয়েছি তাড়িয়ে।ছিল না সহজ কিছু, পদে পদে কত যে বিভ্রম
নানা ছদ্মবেশে এসে মধুর আলাপে
আমাকে ভুলিয়ে সর্বনাশ সাধনের
চোখ-ঝলসানো প্রক্রিয়াকে প্রায়-সফল করেছে
ভেবে চারদিক তীক্ষ্ম হাসি-ঝড়ে ভীষণ কাঁপায়।অকস্মাৎ চোখ খুলে গেলে দেখি এক
নিঝুম কবরস্থানে শুয়ে আছি। নানা ধরনের
কবরের ভেতর কত যে
কাহিনী ঘুমিয়ে আছে, কোন্ গল্পকার
রূপায়িত করতে পারবে সেই অজানাকে? কোকিলের গানে
গুঞ্জরিত হয়ে গোরস্তান আরও বেশি স্তব্ধতায় মগ্ন হয়। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | শারদ বিকেলে মন অকস্মাৎ নেচে ওঠে দূরে
কোথাও জীবনসঙ্গিনীকে
নিয়ে চ’লে যেতে প্রাত্যহিক এলেবেলে
ঝুট-ঝামেলার দাঁত-খিঁচুনি পিছনে ফেলে রেখে।আমরা সদরঘাটে পৌঁছে মোটামুটি
সুন্দর একটি নৌকো ভাড়া ক’রে ভুলে গিয়ে সব
গ্লানি, অর্থক্ষয়ের দুশ্চিন্তা আর নায়ের নতুন গতি
মুছে দিল শারীরিক গ্লানি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর।প্রকৃতির পবিত্র চুম্বনে এই আকাশের নিচে
জীবনসঙ্গিনী জোহরার চেহারায়, মনে হ’লে,
ফুটেছে স্বর্গীয় আভা, যা আগে দেখিনি বহুদিন।
চিত্রকর হ’লে সে-মুহূর্তে আঁকতাম প্রাণ খুলে তার ছবি।আকাশে জেগেছে চাঁদ। ভাবি, এই চাঁদ
হাজার বছর ধ’রে জাগে, মানবের দৃষ্টি থেকে
স’রে যায়, আসে আর যায়। তবু তার রূপ
রয়ে যায় চিরদিন। থাকবে কি শেষ তক? এলোমেলো ভাবি
আমার গাঁয়ের প্রায় কাছে এসে পৌঁছে গেছি ভেবে
নৌকোর মাঝিকে ফিরে যেতে বলি। হায়, এতে
জানি না কী ভাবল সে। আমিও যে আচানক
এইমতো সিদ্ধান্ত নিলাম-তাকে আমি বোঝার কী করে?মনে হ’ল পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি ভুলে
বেগানা কোথায় যেন এসে
পড়েছি জ্যোৎস্নার মায়াজালে বড় প্রতারিত হয়ে।
নিজেকে ধিক্কার দিয়ে মাঝিকে তক্ষুনি নৌকা ফেরাতে জানাই।মাঝি নৌকা ফেরাতেই কারা যেন, মনে হল,
বাঁকা হাসি হেসে ভ’রে দিলো চারদিক।
শুধু আসমানে ক্ষয়ে-যাওয়া বাঁকা চাঁদ
হাসছে কি কাঁদছে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আমার মুঠোয় তোমার স্তন বেহেশতের দ্যুতিময় বিষিদ্ধ ফল
আমার ওষ্ঠঁ তোমার ঠোঁট থেকে
শুষে নেয় আবেহায়াত
আদ্যোপান্ত পাঠ করি তোমাকে জ্ঞানার্থীর নিষ্ঠায়
তোমার চোখের পাখির পাখা আলতো গোটানো
বুকে ঝড়ের আগে মেঘনা নদীর তোলপাড়
দ্রুত সরিয়ে নাও নিজেকে
হয়তো শুনতে পেলে পদশব্দ কাপড়ের খসখসানি
আমার হৃদয় পূর্ণিমা হতে হতে অমাবস্যা
অদৃশ্য ফেরেশতা ঝুঁকে চুমু খেলেন তোমার মাথায়
কালো চুলে নক্ষত্রের মতো দোয়ার ঝলসানি
সম্বিৎ এবং স্থৈর্যের প্রতিমা তুমিকী করে পারো এভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারো
নিজের শরীর এক ঝটকায়
কী ভাবে করেছো রপ্ত এমন প্রশান্তির মুদ্রা
কুকুরের কানের মতো ঝুলতে থাকে আমার অবসন্ন আবেগ
তোমার আঙুলে প্রজাপতির পাখনার কম্পন
মনে হয় বসে আছো পরীস্তানে আলসেমির গালিচায়সোফার হাতলে তোমার হাত গুণীর সোনালি বাদ্য
উঠে দাঁড়াও শাড়ির আঁচল সামলে সুমলে
উৎসবরাতে রঙিন বাতিখচিত গাছের যৌবনের উত্থান
তাকাও আমার দিকে জ্যোৎস্নাঝলসিত
নহরের মতো গভীর দৃষ্টিতে
যেন ভালোবাসা এই প্রথম চোখ মেললোযদি তুমি মুখের উপর দড়াম বন্ধ করে দাও দরজা
কখনো শঙ্খিনী আক্রোশে
আমার হৃদয় গুঁড়িয়ে যাবে পথে ছড়ানো
দুর্ঘটনাকবলিত মোটর কারের কাচের মতো
সেদিন আফ্রিকার অরণ্যে আমার পথ হারানো
রাসায়নিক বৃষ্টিতে ঝলসে-যাওয়া
আমার মুঠোয় আবার তোমার গরবিনী স্তন
পুনরায় ক্ষণকালীন চুম্বন প্রায় বিটিভির
বিদেশী ছবির চুম্বন-দৃশ্যের ধরনে
বিচ্ছেদের সুরমা রঙের ছায়া অস্তিত্বে
দখলীস্বত্ব লিখে দেয়া যন্ত্রণার অনাড়ম্বর হরফে
প্রেতের পদহীন পদশব্দে অন্ধকার-খরগশ উৎকর্ণঅজ্ঞাত ভয় দেয় না ঘুমোতে
গৃহকোণের টেবিলে বইয়ের স্তূপ কখনো বৌদ্ধবিহার
কখনো রেড ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীপতি ক্রেজি হর্সের তেজী মাথা
অপ্রেমের শয্যায় শুয়ে থাকি কাঁটাবন্দী
আগামীকাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক
ভালোবাসার ঝুঁটি-দোলানো নাচ (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | খাতার প্রথম পাতা পুরো নয়, শুধু
দুই তিন পঙ্ক্তি দিয়ে সাজিয়ে হঠাৎ
থেমে যাই। নিজেকে বেজায় খুঁড়ে স্রেফ
থেমে থাকি। কিছুতেই কোনও শব্দ উঁকি
দেয় না অস্থির মনে। কখন অজ্ঞাতে
হঠাৎ মাথায় দুই তিনটি চুল ছিঁড়ে ফেলি-
বস্তুত পাইনি টের। টেবিলে কলম রেখে ধীরে
মাথাটা চেয়ারে রাখতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।চোখ খুলতেই দেখি আলোকিত ঘর আর অদূরে প্রবীণ
একজন রয়েছেন ব’সে-গায়ে তাঁর
হলুদ রঙের আলখাল্লা আর জ্যোৎস্না-রং চুল-দাড়ি
উপস্থিতি তাঁর সাধারণ ঘরটিকে এক
লহমায় স্বর্গের মর্যাদা করে দান। আমি দ্রুত
দাঁড়িয়ে চরণে তাঁর সশ্রদ্ধ প্রমাণ করি নিবেদন।জানি না হাতের ছোঁয়া তাঁর পেয়েছিল কি না,
মাথাটা আমার। পরমুহূর্তেই দেখি
আমার আঁধার ঘরে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক
উপস্থিতি নেই, শুধু রয়ে গেছে অপরূপ চিরন্তন ঘ্রাণ। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ইয়ার বক্সির মজলিশ থেকে সবেমাত্র তিনি
নেমেছেন ধূসর রাস্তায়; তার কণ্ঠনালী ব্যেপে
সদ্য কিছু গজল পাঠের স্মৃতি স্তব্ধতা পোহায়।সুরা মেঘময় করে তাকে; নক্শাদার পাল্কি নয়,
ধোঁয়া ছেড়ে বেবী ট্যাক্সি কাছে আসে প্রতীকের রূপে।
আত্মা আছে কিংবা নেই, এই তর্ক মুলতুবি রেখেগলিতে ঢোকেন ছায়া-প্রায়। কে যেন জানালো তাকে,
‘এই মির্জা, দ্যাখো কত মোহর তোমার পিরহানে
লেগে আছে জ্বলজ্বলে’। শায়ের ভ্রূক্ষেপহীন, একাঘরে ফিরে ঝাড়লেন নিজের কামিজ, লহমায়
জামার আস্তিনে গজলের সুর বাজে; রাত্রি তার
ওপর নিছক নারী, ঝুঁকে-থাকা। তিনি উদাসীন,নীরব থাকেন চেয়ে দূর নক্ষত্রের জলসায়।
জানালার পাশের পেয়ারা গাছ, মসৃণ বেড়াল,
নিদ্রাতুর ঘরদোর জানে না যন্ত্রণা তার আরঅন্তর্গত খর ক্ষরণের রক্তচ্ছাপ প্রকাশিত
নয় বটে। ভগ্নস্বাস্থ্য স্ত্রী-র দিকে কিছুক্ষণ চোখ
রাখেন, শোনেন রুক্ষ, বিরান জমির হাহাকারআর কোনো এক ধ্বংসস্তূপের নাছোড় স্মৃতি তাকে
বিচলিত করে খুব; পাঁজরের খাঁচায় কে পাখি
কাঁদে? বুঝি শ্যামা বুলবুলিকে না পেয়ে কাছে ধারেদুঃখ নয়; নৈশ হাওয়া চেটে নেয় গীতসুধাময়
কসবির আত্মার আতর, নিশীথের প্ররোচনা
বড় তীব্র; গোলাপ বাগানে ঘোরে কবির কংকাল।ভোরের আবীর ঝরে নিরিবিলি শ্যামলীর সুপ্ত
গালিবের সত্তাময়। খোঁয়ারির তীরে জেগে উঠে
তিনি নিশীথের কাছে পাওয়া গজলের রাঙা ওড়নাখোঁজেন হাতের কাছে। ইজারবন্দের গিট খুলে
খুলে পদাবলী পেয়ে যান, কিছু চুম্কি-খসা ওড়না
ওড়ে উল্লসিত রাধাচূড়া গাছে, বাংলার আকাশে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ফেলতে চায় না কেউ, তবু ফেলে দিতে হয় অনেক কিছুই,
দিতে হয় অসহায় সূর্যোদয়ে অথবা সূর্যাস্তে। এ বিজনে
এমন কারুর সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায়, যার সাথে
সারাদিন সারারাত সময় যাপন করে সুখ পেতে
সাধ হয়, তাকে ছেড়ে মন চায় না কস্মিনকালে, তবু
মৃত্যুর শীতল স্বাদ জিভে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা চলে যেত হয়।আমার চোখের মধ্যে যে রূপালি নিঝুম শহর আছে এক
তার অলৌকিক অলিগলি আর হৃদয়ের ধুলো ওড়া পথে
জেগে থাকে তার পদচিহ্ন প্রত্যাশার মতো, হয় না নিশ্চিহ্ন
ঝড় জলে। হাঁসময় সন্ধ্যার আকাশে কবিতার পঙক্তি দোলে,
না কি শাড়ি তার ওড়ে নক্ষত্রমালায়। প্রতীক্ষায় কখন যে
সন্ধ্যার আকাশ ফের ভোরের আকাশ হয়ে যায়, রিক্ত লাগে।কী কী আমি কতদূরে কখন এসেছি ফেলে অবহেলে,
আজ কি পড়বে মনে ঝড়মত্ত এই মধ্য সমুদ্রে হঠাৎ?
অমন ফেলতে হয় কত কিছু, অবিজ্ঞ কাপ্তান জানে, আর্ত
জাহাজ বাঁচাতে হলে। কিন্তু আমি ছেড়ে যাবো
কেন তাকে, যাকে
কী সকালে কী দুপুরে, অপরাহ্নে, অথবা রাত্তিরে এক বেলা
না দেখলে কিছুতেই চলে না আমার? ভালোবাসা,
জানো নাকি
আমিও নিরুপদ্রব বেঁচে যেতে চাই কিছুকাল? কিছুকাল,
যতটুকু পারা যায় মারকুটে পরিবেশে কিল ঘুষি লাথি
মেরে কিংবা খেয়ে রৌদ্রে, খলখলে জ্যোৎস্নার প্রচার আপ্যায়ন
পেয়ে রাজেন্দ্রাণী বলে দরবেশী ধরনে উদ্যানে
করবো প্রবেশ, বসে পড়বো, দোলাবো মাথা বেশ দূরবর্তী
পাখিদের গান শুনে, নামবে গভীর ছায়া ভালোবাসা জুড়ে।
এই আপ্যায়ন পারবে কি করতে রোধ হৃদয়ের অবিরল
শোণিতক্ষরণ? পারবে কি অস্তিত্বের জিভ থেকে মুছে নিতে
কটু স্বাদ? আমাকেই আত্মার অমল অশ্রুধারায় নিয়ত
ধুয়ে দিতে হবে তার হাত, ফেলে যেতে হবে, ছেড়ে যেতে হবে,
যেমন গিয়েছি আগে অসহায়, ব্যর্থ নিরুপায়। ভালো থেকো,
সুখে থেকো বলে আমি এক ফোঁটা অশ্রু হয়ে থাকবো একলা। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | এইতো দু’দিন পরে তুমি চলে যাবে পরদেশে
এ শহর ছেড়ে; ভ্রমণের আনন্দে তোমার মন
ভরপুর-এ কথা বলি না। তবু তুমি চলে যাবে,
তোমাকে যেতেই হবে, যদিও এখানে আমি একা
থাকব লুকিয়ে মনোবেদনা তোমার না থাকার
হেতু, বিচ্ছেদের দিনগুলি রাতগুলি হিংস্রতায়
বসাবে ধারালো দাঁত-নখ হৃদয়ে আমার আর
শোকগ্রস্ত এ ঘর প্রত্যহ খুব করবে বিলাপ।যাবো না তোমার বাড়ি, কেননা দরজা, দ্বাররক্ষী,
সিঁড়ি, সোফা, কোমল গালিচা জানাবে না অভ্যর্থনা
আমাকে সেখানে তুমিহীনতায়। স্মৃতির সুঘ্রাণ
নেয়ার আশায় সে বাড়ির কাছাকাছি যেতে ইচ্ছে
হলেও থাকব দূরে। ফিরে এলে স্বগৃহে ক্লান্তির
ভারে নত, আর্তকণ্ঠ সিঁড়ি আমাকে প্রবোধ দেবে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | আমাকে প্রায়শ এক স্বাস্থ্যেজ্জ্বল স্বর্ণাভ ঈগল
উপহাস করে দূর পর্বতশিখর থেকে; ঠারে
ঠোরে দ্যাখে দাগাবাজ অসুখ আমাকে বারে বারে
বেড়াল-ইঁদুর খেলা খেলে, আর করে বেদখল-
রোদে ঘুরে বেড়ানো বৃষ্টিতে ঝিম ভেজা-এ সকল
ছোট ছোট সুখ থেকে। তার সঙ্গে শীতসাঁঝে হিম
সয়ে বাগিচায় বসা কি কঠিন, চোখের পিদিম
এখনই নিভল বলে, গ্রর্ন্থপাঠ হতেছে নিশ্চলস্বর্ণপ্রভ হে ঈগল জেনেছি তোমার তকব্বরি
প্রসিদ্ধ জগতে, কিন্তু জেনে রাখো আমিও চূড়ায়
আমি পক্ষী, যেখানে পুষ্পিত করে বসবাস গৌরী
আমার আপন মনে; তোমার মতোই অধীশ্বার
আছি, করায়ত্ত যার রত্নদ্বীপ, তারার গুঁড়ায়
গড়া, যার তীরে বাঁধা ইচ্ছাতরী এক অনশ্বর। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | তোমাকে একবার এখানে ডেকে নিয়ে
আসতে চাই এ গাছপালার
ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে রাখা বাড়িটার
কাছে। ভেতরে যাবার দরকার নেই হে হাওয়া,
এই লতাপাতার ঘ্রাণ
পাখির গান, তোমার
কেমন লাগবে, জানি না।খনিক এগিয়ে
গাছের ডাল সরিয়ে একটু ঝুঁকে
যদি দাঁড়াও, কলিং বেল বাজাতে চাও,
তোমার কাঁধে এসে
বসবে ফুরফুরে এক প্রজাপতি,
কিছু মনে করো না।হাওয়া,
লতাপাতার সবুজ ঘ্রাণ,
নৈঃশব্দ্যের তান, বাড়ির দীর্ঘশ্বাস।
বাড়ির ভেতরে দ্রষ্টব্য
এই আর কি
ভেতরে নানা বয়েসী
ক’জন মানুষের বসবাস,
বয়সে সবচেয়ে প্রবীণ যিনি
থাকেন চুপচাপ, মাঝে-মধ্যে দু’বছরের
এক শিশু, তাকে জড়িয়ে ধরে
পেছন থেকে, তিনি মৃদু হেসে
কিছুক্ষণ খেলা করেন ওর সঙ্গে। তারপর
তার কলম কাগজে সাজায় অক্ষরমালা।ভেতরে যাওয়ার কী দরকার?
কী প্রয়োজন ওর নৈঃসঙ্গ্যের মুহূর্তগুলোকে
কাচের গুঁড়ো করে দেওয়ার?
তিনি টেবিলে ঝুঁকে লিখুন,
তাঁকে লিখতে দাও।
নিজের দ্রুত কমে-যাওয়া সময়কে
তিনি শাসন করছেন
শব্দের হিরন্ময় চাবুকে।হাওয়ায় উডুক ওর শাদা চুল,
তেজী ঘোড়ার মতো
চলুক ওর কলম। একদিন
তিনি এ বাড়িতে হবেন গরহাজির,
ওকে পাওয়া যাবে না কোথাও।
কান্নার রোল উঠবে বাড়িটায়,
একদিন স্তব্ধ হবে মাতম,
হয়ত থাকবে একটি কি দু’টি
দীর্ঘশ্বাস, কিছু ফোঁপানি’।
পঞ্চভূতে নাস্তির অবাধ উৎসব।ভেতরে প্রবেশ না-ই বা করলে,
লতাপাতার সবুজ ঘ্রাণ,
প্রজাপতির স্পর্শ বুকের ভেতর নিয়ে
খানিক জিরিয়ে চলে যাও
কোথাও চায়ের আসরে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এক মধ্যরাতে আমার পারিবারিক ত্র্যালবামের
গান শুনে জেগে উঠলাম
পুরোনো দিনের গানে নীলাম্বরী শাড়ির মন-কেমন-করা
ঝলসানি মেশকে আম্বরের ঘ্রাণ
হেমন্তের উদোম বিকেলে নববধূর চাউনি
আলবোলার ধোঁয়াটে গুড় গুড় ধ্বনি
আগদুয়ারে আতিথেয়তা খিড়কি পুকুরের
লাজনম্র সজলতা চিলেকোঠার নির্জনতাসে গান নিয়ে যায় আমাকে ছায়াতুর এক পথে
হলদে পাতার ওপর বিছানো ডোরাকাটা
শতরজ্ঞির প্রতি টিফিন ক্যারিয়ার আর ফলমূলের প্রতি
কয়কটি কমলালেবু গড়াতে গড়াতে আসে
ডুবে যায় কবরখানার দবিজ ঘাসে
সে গান নিয়ে যায় আমাকে দূর
সমুদ্রতীরে ভেজা বালিতে পদচ্ছাপ দেখায়
দেখায় মুখচ্ছবির পেছনে সূর্যাস্তআমার পারিবারিক ত্র্যালবাম জলকন্যার মতো গান গায়
ঘুমায় তারা আর গুল্মময় স্বপ্নের ভেতরে কখনোবা
থমকে দাঁড়ায় প্রবাল সিঁড়ির ধাপে
সুদূর গ্রামের পোড়াবাড়িকে জানায় অভিবাদন
আমার কল্পনার গা চটে আস্তে সুস্থে
আমার অস্তিত্ব স্বপ্নের পাখির মতো
উড়ে যেতে চায় তার কাগুজ ঠোঁটে চূমো খেয়ে
বুকে জড়িয়ে ধরে।
শাদা কথায় বললে দাঁড়ায়
আমার পারিবারিক ত্র্যালবাম এক ঐন্দ্রজালিক যে
দেখাচ্ছে তার মোহসঞ্চারী বিরতিহীন খেলাকাঠের পিঁড়িতে বসে বটিতে সবুজ কুমড়ো
কাটছেন আমার মা গ্রীনবোটে আব্বা বাবা আমার
তাঁর গায়ে ওভারকোট দূর আকাশে হংসমিথুন
আর আবছা রূপোলি মটরশুঁটির মতো
একটি কি দুটি তারা প্রধান মাঝি হাল ধরেছে উজানে
বার্থ ডে কেকে ছুরি চালাচ্ছে আমার সাত বছরের কন্যা
আমার নেই-যে পুত্র তার কপালে ব্যাণ্ডেজ ঠোঁটে হাসি
বর্ষার পানিতে সয়লাব উঠোনে সাঁতার কাটছে
যুগল হাঁস একটি গ্যাছে নেউলের পেটে
কয়কটা শাদা লাল কালো মুরগি চরে উঠোনে
এখন ওরা গরহাজির
আমার একজন সুদর্শন তরুণ স্বজন চেয়ে থাকে নিষ্পলক যে
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেনি
আমি পারিবারিক ত্র্যালবামটির সঙ্গে ক্রমাগত
এমন আচরণ করি যেন সে যক্ষের ধন
কখনো তার ভেতরে বিধবার ধবধবে শাড়ির
মতো দুপুর কখনো অগাধ জ্যোৎস্না বিস্তার
কখনো তার ভেতর থেকে ভেসে আসে আকর্ণ হাসি
কখনো ডুকরে ওঠে কান্না
সেখানে কখনো ঈদের পোশাকের ঝলমলে উচ্ছ্বাস
কখনোবা কবরের বাতির ব্যথিত কম্পন। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,
ফুর্তি করো সবান্ধব
সেজন্যেও নয়।
বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।
অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ, ফুল, পাখি
এমনকি নারী ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে-গলিতে,
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক,
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।
অথচ জানেনা ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি। |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | নিজের শহর ছেড়ে যখন বিদেশে যেতে হয়,
নিরানন্দ হয়ে পড়ি, মনে জমে মেঘ ইতস্তত,
বিষণ্নতা এসে বসে মুখোমুখি ঘাতকের মতো
ঠাণ্ডা চক্ষুদ্বয় নিয়ে, সারাক্ষণ মনে জাগে ভয়।যদি না কখনো ফিরে আসি আর, এই ঘরদোর,
বই, কবিতার খাতা, লেখার টেবিল, জানালার
পর্দা, খাট, রবীন্দ্রনাথের ছবি ক্যাসেট প্লেয়ার
কোনোদিন মনে জাগাবে না পুলক, স্বপ্নের-ঘোর।প্রিয়জনদের মুখ দেখব না, চার বছরের
পৌত্রীর কোমল কথা শুনব না, দেখব না, হায়,
ওর হাসি আর যাকে একদিন না দেখলে মনে
সভ্যতা বিলুপ্ত হয় লহমায়, তার দু’চোখের
মমতায় কখনো আমার চিত্ত আনন্দ-ধারায়
হবে না বিশদ স্নাত পাশাপাশি বসে ক্ষণে ক্ষণে! (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | শোকমূলক | সমরেশদা, কী করে জানবো বন্ধু রশীদ করীমের ভাড়াটে
ফ্ল্যাটবাড়িতে সেই রাতেই হবে
আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা? কী করে জানবো
আর কোনোদিনই স্মৃতির সহায়তা ছাড়া
দেখবো না আপনার অবিশ্বাস্য সুন্দর
হাসি উদ্ভাসিত মুখ?
চারজনের নরক গুলজার করা আড্ডা। আপনি, জিল্লুর,
খোদ মেহমান নেওয়াজ গৃহকর্তা আর আমি। কখন যে নগ্নিকা
সন্ধ্যার আব্রু ঢাকা পড়লো রাত্রির জমকালো আলোয়ানে,
টের পাই নি। অবিশ্যি আসরের মুল গায়েন
ছিলেন আপনি আর আমরা স্বেচ্ছায়
মেনে দিয়েছিলাম, দোহারের ভূমিকা। যখন কথার
রেণুসমূহ ঝরে পড়েছিল আপনার
ভেজা-ভেজা ঠোঁট থেকে, ভাবছিলাম কত নারীর
মন জয় করেছে এই হাসি, কথা বলার ঢঙ এবং
মুখাবয়ব। ইরানী এক মহিলা কবি বিষয়ে
বলতে গিয়ে, লক্ষ করলাম, আপনার চোখে হাফিজের গজল,
উজ্জ্বল দু’টি বাহু, আর
যৌবনদীপ্ত উদ্ধত বুক আর কবরে-নুয়ে-পড়া
গোলাপের ছায়া। তখন আপনার ক্লান্তি গ্যাছে অস্তাচলে।সমরেশদা, একসময় আমাদের সেই আসর ছেড়ে
চলে গেল জিল্লুর, বাড়ি ফেরার
তাড়া ছিল ওর। কথাবার্তার ফাঁকে এক সময়
হঠাৎ বললেন আমাকে, ‘আসুন, এখন থেকে আমরা
একে অন্যকে তুমি বলি, কী জানেন, আপনি, কথাটার
মধ্যে দূরত্ব বেশ ঘাড় বেঁকিয়ে বসে থাকো
আপনি, সমরেশদা, আমাকে তুমি বলতে গিয়ে, মনে পড়ে,
বেশ কয়েকবার হোঁচট খেলেন। যখন ‘তুমি’ আপনার
কণ্ঠে সাবলীল খেলা শুরু করলো,
তখনও আমি সংকোচে বিহ্বল, খানা-খন্দে পড়ে যাওয়া
মানুষের মতো লুটোপুটি খাচ্ছি। বহু চেষ্টা করেও
আমার আপনাকে আর তুমি বলা হলো না।
সমরেশদা, কী করে মেনে নেবো আপনার মতো
একজন তারুণ্যে টগবগে মানুষ
আর নেই কলরবময় কলকাতায়, অন্য কোথাও নেই?
কী করে মেনে নেবো মৃত্যুর এই প্রহারকে,
যা আপনাকে নিমেষে চূর্ণ করেছে অভ্রগুড়োর মতো?
হায়, এখন আপনি
বিলীন পঞ্চভূতে এবং জীবন্ত শুধু অগণিত শব্দের সংসারে।
আপনারা আত্মা কি বিবর থেকে বেরিয়ে
উড়ে গ্যাছো উর্ধ্বলোকে প্রজাপতির মতো? এখন আপনি
অনেক দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত; উপন্যাসের
কিস্তি শেষ করার তাগিদ নেই নাছোড় সম্পাদকের
তরফ থেকে, তাড়া নেই অর্থ উপার্জনের,
আপনি এখন মুক্ত ভনভনে স্বাক্ষরশিকারিদের
হৈ-হল্লা থেকে, সমালোচকদের হুল-ফোটানো কলমের
খোঁচা থেকে, স্খলনের অপবাদ
বয়ে বেড়ানো থেকে। মৃত্যু ঢালের ধরনে
আড়ালে রেখেছে আপনাকে বহুরূপী ঝুটঝামেলা থেকে।এমন এক সময় ছিল, যখন মৃত্যুভয়ে
আমার রক্তে তুষার জমে যেতো। মৃত্যুর ওপর
ভীষণ্ন রাগ হতো আমার,
কেননা বহু মহাত্মা, মনীষী আর শিল্পীকে
শিকার করেছে সেই নির্বিকার
নিষাদ, আপনিও রেহাই পেলেন না তার
তীর থেকে। এখন বুঝি, বৃথা এই ভয়, ক্রোধ কিংবা ঘৃণা।
এর কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না,
অপ্রতিদ্বন্দ্বী দাবাড়ুর মতো সে খেলে চলেছে
নিজের খেলা। আমরা যারা ওর বোড়ে,
তারা ঘায়েল হচ্ছি নির্ধারিত কালে। তাই, বাটি থেকে
সমস্ত দুধ মাটিতে পড়ে গেলে
যেমন কপালে করাঘাত করলে কোনো লাভ নেই,
তেমনি নিষ্ফল মৃত্যুর বিরুদ্ধে অপটু অভিনেতার মতো
তর্জন গর্জন করা। শেষ অব্দি মেনে নিতেই হয়
যে-কোনো চলে-যাওয়া প্রতিবাদ ফেনা হয়ে উবে যায় হাওয়ায়।একদা আপনি সওয়ার হয়েছিলেন
আগুন রঙের এক বলীয়ান ঘোড়ায়। তার
দাপটে কেঁপে উঠেছিল
ধনিক গোষ্ঠীর ভিত। কিন্তু কী যে হলো একদিন
স্বেচ্ছায় সেই ঘোড়ার জিনচ্যুত হলেন। সে রাতে এর কারণ
জানতে চেয়েছিলাম আপনার কাছে। কে না জানে
আধুনিক বাংলা গদ্যশৈলীর
আপনি এক প্রধান স্রষ্টা। আপনি সেই গদ্যের
কলাকৌশল গলায় খেলিয়ে
উত্তর দিতে চেষ্টা করলেন। মাফ করবেন,
আপনার উক্তিতে মাধর্য ছিল যত বেশি,
যুক্তি ছিল ততটা কম। আপনাকে মনে হচ্ছিল
সেই ক্লান্ত পাখির মতো যে
আটকে গ্যাছে আগুনধরা সরোবরে। সমরেশদা,
হয়তো আপনার কাছে
আগুন রঙের ঘোড়ার নিঃশ্বাসের আঁচ অসহ্য ঠেকেছিল!আমার এই তুচ্ছ লেখা কি বিবেচিত হবে
শোকগাথা হিসেবে? এখন যে বলপেন দিয়ে দিখছি,
তার চোখে শোকের কুয়াশা কোথায়? কোথায়
সেই হাহাকার তার গলায়
যা শুনে ডুকরে উঠবে প্রতিটি পংক্তি? সমরেশদা,
কী ব্যর্থ আর অসহায় এই লোক,
যে আপনার যোগ্য একটি শোকগাথাও আজ
রচনা করতে পারলো না।
নিজেকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া কী-ই বা আর
করতে পারে সে? হাতের কলমটাকে টুকরো টুকরো করে
ভেঙে ফেলা ছাড়া কী আর
করার আছে তার? কখনো হয়তো কোনো নির্ঘুম রাতে
আপনার কোনো লেখা পড়ে, কোনো কথা ভেবে
অথবা গ্লাশে চুমুক দেয়ার ভঙ্গি মনে করে
আমার অন্তরাত্মা হু হু করে উঠবে,
কেউ জানবে না।সমরেশদা, আজ বাতাসের কানে মুখ রেখে
আপনাকে আর্তস্বরে ‘তুমি’ বলে ডাকছি, এই দুনিয়ার
দর্পণ ভেদ করে কি আমার এই ডাক
পৌঁছুচ্ছে তোমার কাছে? পৌঁছুক আর না-ই পৌঁছুক,
এই প্রথমবারের মতো আপনাকে তুমি বলে সম্ভাষণ করলাম,
অথচ তা’ শোনার জন্যে তুমি আর নেই। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | বিশদ তদন্তসূত্রে জানা গেল ফাল্গুন সন্ধ্যায়-
তোমার হিশেব নাকি, কবি, খুবই পাকা চিরদিন।
বাউল গানের মতো তোমার জীবন উদাসীন,
এই তো জানতো লোকে, তোমাকে অনেকে অসহায়,
বড় জবুথবু বলে করেছে শনাক্ত, তবু, হায়,
সেয়ানা হিশেবীরূপে খ্যাতি রটে তোমার হে কবি।
তোমার হৃদয়ে জ্বলে সর্বদাই যে রক্তকরবী
তাও নাকি হিশেবেরই ফুল? যে কিন্নর গান গায়তোমার ভিতরে ভেলা অবেলায়, যে-ও বুঝি গণিতের
ক্রীতদাস? যে প্রেমিক তোমার কংকাল জুড়ে আছে,
তার হাতে যোগ-বিয়োগের ফলাফলময় খাতা?
অথচ যদ্দুর জানি করেছে উজাড় জীবনের
সমস্ত তবিল তুমি গোপন জুয়ায়, যারা বাঁচে
নিক্তিতে ওজন করে তুমি নও তাদের উদ্গাতা। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এই যে এখন এই হাড়-কাঁপানো শীতের ভোরবেলা
কাঠের চেয়ারে ব’সে একটি কবিতা
রচনার কথা ভেবে কলম নিয়েছি হাতে, দেখছি বাইরে
ধূসর কুয়াশা তার বিছিয়েছে জাল, যখন বাড়ির
সবাই ঘুমের গাঢ় মখমলে ডুবে আছে,
আমি কিছু শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছি, যেমন
নাবিক তালাশ করে প্রকৃতির মায়াঘেরা দ্বীপপুঞ্জ দীপ্র
আগ্রহ-উন্মুখ চোখে। প্রকৃত সন্ধান জেগে আছে
আমার এখনও ঢের ঢের দিন রাত
মানস ভ্রমণে মগ্ন থাকার পরেও। ডাঁই ডাঁই
শাদা কাগজের বুকে হরফের ছবি
আঁকা হয়ে গেছে, তবু সৃজনের ক্ষুধায় কাতর আজও আমি।কী হয়, কী হবে সারি সারি শব্দ সাজিয়ে কাগজে?
আমি তো খুঁজি অমরতা কোনওকালে
পঙ্ক্তিমালা কালের গলায়
সাগ্রহে ঝুলিয়ে দিয়ে। বিনীত ভঙ্গিতে যতটুকু
পেরেছি সঞ্চয় থেকে করেছি অর্পণ। বলা যায়,
দিয়েছি উজাড় করে সব, জানি না কিছুর তার
প্রকৃত গৃহীত হবে, নাকি, শুধু
হেলার কলঙ্ক নিয়ে লুটোবে ধুলোয়!
হোক যত অবহেলা, না পড়ার সপ্রশংস দৃষ্টি কাব্যনাম্নী
রূপসীর এই অভাজজনের ওপর, তবু তার
পলায়নপর কায়া কিংবা ছায়ার পেছনে যত পারি
তত ষড়ঋতু অবিরাম ছুটব তুমুল লোকালয়ে কিংবা
বিরানায় পর্বত চূড়ায় আর উদাস প্রান্তরে
দেখব সে কতটা নিঠুরা উদাসীন হতে পারে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | আজ ফুরফুরে হাওয়ার বিকেলে সদ্য প্রেস থেকে
বেরিয়ে-আসা আমার একটি কাব্যগ্রন্থের
প্রকাশনা উৎসব। কোথায়?
জায়গাটার নাম অকথিত থাক, যদিও
ভূতলবাসী নয় আমার কবিতার বই। গ্রন্থে
ঠাই-পেয়ে-যাওয়া
রচনাগুলি কবিতা না পদ্য, এ নিয়ে বাছা-বাছা
গুণীজনের মধ্যে
বিস্তর মতভেদ লক্ষ্য করা গেছে, যখন এগুলি
প্রকাশিত হচ্ছিল কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিনে কিংবা
প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায়।একে একে অতিথিরা এলেন ধরাচূড়া নিয়ে,
যাবে বলে আসন গ্রহণ করলেন। দু’চারজন জবরদস্ত
সমালোচক, যাঁরা মনে মনে
শানিয়ে নিচ্ছিলেন তাঁদের প্রিয় বাক্যগুলি,
পরখ করছিলেন সেই ঝকঝকে
তূণ, যেখান থেকে ছুড়বেন কবির হৃদয় লক্ষ্য করে
বিষমাখানো তীর আর
নিজেদের অর্জুন ভেবে পার্শ্ববতী বনোয়ারির
দিকে তাকাবেন প্রশংসাকাতর
দৃষ্টিতে, তাঁরাও বসলেন আয়েশী আঙ্গিকে
যে যার আসনে।
কারো ঠোঁটে স্মিত হাসি, কেউবা
ঈষৎ গম্ভীর, যেন খালে গলা-ডোবানো
মোষ; একটা চাপা গুঞ্জন ঘরময়। কতিপয়
রাগী ছোকরা খিস্তি ছুড়ে দিচ্ছিল
টেবিলে সাজিয়ে-রাখা আমার অতিশয় লাজুক
কাব্যগ্রন্থটির উদ্দেশে। সভাপতি
তাঁর নির্ধারিত আসনটি অলংকৃত করলেন
ঘোষকের আমন্ত্রণে। প্রধান অতিথি
আর বক্তা মহোদয়গণ অনুসরণ
করলেন তাঁকে।ঘোষক কী যেন বলতে চাইলেন তার মখমল-কোমল
কণ্ঠস্বরে মাইক্রোফোনের
খুব কাছে মুখ নিয়ে। আর সে মুহূর্তেরই
আমার কাব্যগ্রন্থের অন্তঃপুর থেকে
কবিতার অক্ষরগুলো বেরিয়ে এসে সারা ঘরে
উড়তে শুরু করল এক ঝাঁক প্রজাপতির মতো।
কেউ এসে বসে পড়ল সভাপতির মোগল সম্রাটের
দাড়ির মতো দবিজ দাড়ির ডগায়, কেউ
কোনো সুন্দরীর রঙিন ঠোঁটে চুমু খেল
অনেকক্ষণ ধরে। কেউ কেউ
সুড়সুড়ি দিল প্রধান অতিথির কানের ভেতর,
কেউবা হঠাৎ প্রজাপতি থেকে দূরন্ত বোলতায়
রূপান্তরিত হয়ে হুল ফোটাতে লাগল
সমালোচকদের বাঙির মতো ভুঁড়ি আর ডাগর
পাকাপোক্ত পাছায়। আহারে উহুরে শব্দে
সভাঘর বনে গেল
মেছো বাজার খদ্দের বিহনে।
আমার কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবটাই
ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে ভেবে
দিগ্ধিদিক ছুটতে শুরু করি আর উড়ন্ত অক্ষরগুলোকে
বইয়ের ভেতর ফিরিয়ে আনার জন্যে
কখনো মিনতি জানাই এবং কখনো বজ্রে ধার করে
অনবরত ধমকাতে থাকি জেহোভার মতো। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কাল রাতে স্বপ্নে আমি লালনের আরশি নগর
দেখেছি অনেকক্ষণ, মনে হয়, আলো-আঁধারিতে।
কেমন পড়শি ছিল কাছে, ধারে, কিবা তার ঘর
দোর, মনে নেই, বুঝি দেহ তার রঙিন শাড়িতে
ছিল ঢাকা, চোখ দু’টি টানা টানা, অত্যন্ত গভীর,
ছুঁতে গিয়ে তাকে আমি গহীন গাঙের জলরেখা
যেন বা করেছি স্পর্শ, পরিচিত এই গ্রহটির
কেউ নয়, বুঝি তাই আজো প্রকৃত হয় নি দেখা।লালনের গানের আড়ালে যার পদধ্বনি বাজে,
বাউলের দোতারার সুর যাকে করে বন্ধনীয়,
এ আমি কী করে পাবো তাকে আমার সকল কাজে?
‘সে আছে নদীর পাশে সুর হয়ে, তাকে চিনে নিও,’
বলেই বাউল এক অগোচরে করেন প্রস্থান,
সাথে সাথে আমার নগর হয় লালনের গান। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আমরা যা লিখি তা’ নিয়ে হরহামেশা
চলছে এক হৈ হুল্লোড়
অবশ্য লেখকদের নিজ নিজ চক্রে।
এ ওর ঠ্যাং ধরে টানছে,
অমুক তমুকের চৌদ্দ গুষ্টির পিণ্ডি
চটকাচ্ছে, অশ্লীল কেচ্ছা রটানোর মতলবে
ছিটোচ্ছে বিস্তর কালি। থুতু ছুঁড়ে মারছে
আকাশে নিজে গিলে ফেলার জন্যে।অথচ আমরা যা লিখি তা’
স্রোতের দীয়া বৈ তো নয়। ঢেউগুলি
ওদের মাথায় বয়ে নিয়ে চলেছে নিরুদ্দেশে।
কোনো কোনো দীয়া, বলা যায়, যাত্রারম্ভেই
যাবে উল্টে, হবে দম্ভের ভরাডুবি, মধ্যপথে নিভে যাবে অনেকে,
একটি কি দু’টি হয়ত
ভিড়বে অভীষ্ট তীরে। অতএর আমরা যা’ লিখি
তা’ নিয়ে মিছেমিছি এমন শোরগোল কেন? কী দরকার
লোমশ বুক চাপড়াবার? আখেরে
গুয়ে গড়াগড়ি যাওয়া এতই কি জরুরি? (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | একটি গাধাকে আমি প্রতিদিন দেখি আশে পাশে,
শহরে নিঃসঙ্গ ভিড়ে,আমার সান্নিধ্যে দেখি রোজ
আওলাদ হোসেন লেনের মোড়ে, বাবুর বাজারে,
ইসলামপুরে, বঙ্গবন্ধু অ্যাভেন্যুর ফুটপাথে, সিদ্ধেশ্বরী,
পলাশী বেইলী রোডে, বুড়িগঙ্গা নদীটির তীরে
মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে, ধানমন্ডি লেকের ওপারে।
হঠাৎ কখনো রমনা পার্কে তার দেখা পাওয়া যায়,
একটি গাধার সঙ্গে ঘুরে ফিরে দেখা হয় প্রত্যহ আমার।তাকে দেখে মনে হয়, যেন দার্শনিক, অস্তিত্ব কি অনস্তিত্ব
নিয়ে চিন্তাবিষ্ট খুব চলেছেন একা, তাবৎ বস্তুর প্রতি
বড়ো উদাসীন;
এবং কর্তব্যাক্লান্ত ট্রাফিক পুলিশ, ক্রুশচিহ্ন আইল্যান্ডে,
বেলা অবেলায় তাকে ঈষৎ মুচকি হেসে পথ ছেড়ে দ্যায় বার বার।গাধাটির কথা বলিহারি, কিছুই দেখে না যেন
চোখ মেলে, পথ হাঁটে একা-একা, বিস্তর ধূলায়
আরবী রেখার মতো নক্শা
তৈরী ক’রে অচেতনভাবে। কাকে বলে আয়কর ফাঁকি দেয়া,
সুরক্ষিত বাক্সের ভেতর থেকে ব্যালট পেপার চুরি আর
টিকিটবিহীন রেল ভ্রমণের সাধ মেটানো, বস্তুত জানে না সে।
কখনো ঘেসেড়া ডাকে, খচ্চরের ভিড় লুব্ধতায়
তার খুব অন্তরঙ্গ হ’তে চায়। মনে পড়ে রজকের পৃষ্ঠপোষকতা
ছিলো বহুদিন, আজ রজকের ঘাট থেকে দূরে,
বহুদূরে চলে এসেছে সে, স্মৃতি ছেঁড়া দূববার মতন ওড়ে,
মাঝে মাঝে অপরাহ্নে ঘাসের সৌন্দর্য দেখে ভালো লাগে তার।
কৃপাপ্রার্থী নয় কারো, তবু বিশ্বাসঘাতকতার চুমো নিয়ে
গালে গূঢ় ডুমুর ফুলের কাছে কামগন্ধহীন রজকিনী প্রেম চায়।তাঁর চক্ষুদ্বয়ে দ্বিপ্রহরে চিলডাকা আকাশের
প্রতিধ্বনি, কবিতার লাইনের মতো অনুকরণকাতর
অবরুদ্ধ নগরীর শব্দাবলী, দূর অনার্য রাত্রির জ্যোৎস্না-বিহ্বলতা,
মায়া কাননের ফুল, পরীর দেশের
রহস্যময়তা আর নিগৃহীত কোবিদের মেধার রোদ্দুর
মাথার ভেতরে তার এজমালী তত্ত্বের তথ্যের দীপাবলী,
আত্তারের সহজিয়া গল্প ছলে সুসমাচারের স্নিগ্ধ কোমল গান্ধার।আসিসির সন্ত ফ্রান্সিসের মতো নিজেকে অভুক্ত রেখে কৃশ
হয়, হাঁটে চরাচরব্যাপী ঝড়ে, বৃষ্টিপাতে আর
তুষামৌলির দিকে দৃষ্টি রেখে পর্বতারোহণে মাতে, সঙ্গীহীনতায়
নিজের সঙ্গেই কথা বলে বারংবার। মুখমন্ডলের
রুক্ষতা ক্রমশ বাড়ে, দাঁতে ক্ষয়, পায়ে মস্ত ক্ষত,
শুধু চক্ষুদ্বয় তার সন্তের চোখের মতো বড়ো জ্বলজ্বলে-
যা উপোসে, কায়ক্লেশে, ক্রমাগত উর্ধ্বারোহণে এমন হয়।কুষ্ঠরোগীদের ক্ষতে হাত রাখে, চুমো খায় গলিত ললাটে
দ্বিধাহীন বারংবার, যাত্রা করে দুর্ভিক্ষের প্রতি,
মড়কের প্রতি, নানাদেশী শীর্ণ উদ্বাস্তুর প্রতি,
বিকলাঙ্গ শিশুদের প্রতি, অন্ধের শিবিরে আর
মৃত্যুপথযাত্রী জীর্ণ পতিতার প্রতি,
যোজন যোজনব্যাপী কাঁটাতর, নিযাতিত রাজবন্দীদের প্রতি,
যাত্রা করে বধ্যভূমি আর ফাঁসির মঞ্চের প্রতি।
এবং প্রকৃত পরী তার পদ্মপাতা-কানে চুমো খায়,
কোজাগরী পূর্ণিমায়, ব্যাকুল সে খোঁজে সেই চুম্বনের মানে। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | হঠাৎ হারিয়ে ফেলি যদি দৃষ্টিশক্তি কোনোদিন,
তবুও তোমাকে আমি দেখবো সর্বদা সবখানে।
যদি পক্ষাঘাতে হই হীনবল, চলৎশক্তিহীন,
তথাপি নিশ্চিত আমি ছুটে যাবো তোমারই বাগানে,
যেখানে থাকবে বসে তুমি সবুজ মেঘের মতো
ঘাসে কিংবা ডাল থেকে অন্যমনে তুলে নেবে ফুল।
যদি কোনো দ্রুত ধাবমান যান কিংবা দৃষ্ট ক্ষত
কেড়ে নেয় আমার দু’হাত, তবু তোমাকে ব্যাকুল
বাঁধবো নিবিড় আলিঙ্গনে। যদি ওষ্ঠ মুছে যায়
নিষ্ঠুর ফুৎকারে কারো, তবু গাঢ় করবো চুম্বন
তোমার মদির তাপময় অস্তিত্বের কিনারায়
বারংবার, যদি স্তদ্ধ হয়ে যায় এই হৃৎস্পন্দন
আমার, তবুও শিরাপুঞ্জে প্রতি রক্তকণিকায়
তোমাকে ধারণ করে একা পড়ে থাকবো শয্যায়। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | ভরাট দুপুর আর নিশুতি রাত্তির নিয়ে বুকে
প্রত্যহ সে করে চলাফেরা
আশেপাশে, কথোপকথনে মাতে পথ ঘাটে যদি
ইচ্ছে হয় শুধায় কুশল পাত্রমিত্রদের। কখনো সখনো
তাকে যায় দেখা রেললাইনে, কখনো ডোবার ধারে
কাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা, কী যেন অধীর দেখে নিস্তরঙ্গ
জরৎ সবুজ জলে, আঙুলে বসন্ত নিয়ে কখনো চালায়
ব’সে মাপে অন্ধকার, জ্যোৎস্না, কখনো-বা
ল্যাস্পপোস্টে ব’সে থাকে দু’হাত বাড়িয়ে
আকাশের দিকে, যেন নেবে করতলে
চমৎকার আসমানী পণ্য-
চাঁদের ভগ্নাংশ, নক্ষত্রের ফুলকি অথবা নীলিমা
যা’ পড়ে পড়ুক।ঘরে এসে ঢুকলেই দ্যাখে চার দেয়ালের একটাও
নেই কাছেধারে, ছাদ মেঘ হয়ে ভাসে, ‘ঘর তবুতো ঘর”
ব’লে সে গভীর নিদ্রা যায় নগ্ন উদার মেঝেতে।
স্বপ্নের চাতালে।লাল বল অতিশয় চপল এবং
সবুজ পুষ্পতি ট্রেন বাজায় বিদায়ী বাঁশি, ট্রাফিক পুলিশ
চিনির পুতুল হয়ে দিকদর্শী অত্যন্ত নিপুণ।সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, যখন ভারিক্কী এক
কাকাতুয়া আপিসের বড় কর্মকর্তার ধরনে।কার্যকারণেরহদিশ খুঁজতে গিয়ে বেজায় গলদঘর্ম হন।
নিদ্রাল শিয়রে ব’সে পাখি বলে এ কেমন টেঁটিয়া মানুষ,
কেমন দুনিয়াছাড়া ঘুমোচ্ছে নিটোল কী-যে, যেন
চতুর্ধারে নেই কোনো বালা মুসিবৎ।
সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, ভীষণ স্তম্ভিত পোকা ও মাকড়। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কৃতী সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মরণেযাই নি পায়রাবন্দে, তবুও বেগম রোকেয়ার
কবেকার শোকগ্রস্ত বাড়ির কঙ্কাল, ভিটেমাটি
এবং সেখানকার ধূলিকণা, লতাগুল্ম আর
লাউয়ের মাচান, ধানক্ষেত, কুয়োতলা, ছেঁড়া পাটি
বর্গচাষি, বাল্য বিয়ে-পড়ানো মৌলভী, ছমিরণ,
দিনভর খাটুনির ধকল-পোহানো কিশোরীর
খড়ের উপর ঘুম-ইত্যাদি দেখেছি, মোনাজাত,
তোমারই সৌজন্যে; সেই ঋণ স্বীকারে অকুণ্ঠ আমি।কী করে ভুলব মাকড়া বুড়ো, তার চৌদ্দ বছরের
দীপ্ত বউ, হাওয়া বিবি এবং সুরমা নাম্নী এক
পরিণীতা বালিকার কথা? তুমি ছিলে বলে অবজ্ঞাত
তারা ঠাঁই পেলো ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে। ছিলে
লাজুক, অথচ দৃঢ়চেতা, আদর্শে অটল আর
প্রগতির পথে প্রতিক্ষণ সংগ্রামী, নিঃশঙ্ক যাত্রী। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | সেদিনও সকাল শহরের মুখে সতেজ আবির
কিছু দিয়েছিলো মেখে। ময়লা গলির মোড়ে নিডর বালক
ডাংগুলি খেলতে-খেলতে
আইসক্রিমের প্রতি গিয়েছিলো উড়ে
গাংচিল ভঙ্গিমায়। কেউ-কেউ পাবদা মাছের শুরুয়ায়
ডুবিয়ে আঙুল
ঘড়ির কাঁটার প্রতি রেখেছিলো চোখ,
অফিসের তাড়া ছিলো বলে।
সেদিনও কোথাও
দাম্পত্য কলহ ছিলো, ছিলো কিছু প্রেমের সংলাপ;
নিউজপ্রিন্টের বুকে ছিলো
স্মরণমন্থনকারী ফাল্গুনের একরাশ উদ্ভিন্ন অক্ষর।একস্মাৎ কী-যে হলো, শহরের পথে
দুপুরেই সন্ধ্যা এলো নেমে, যেন রূপান্তরে গলগোথা ঢাকা
কেরানীর কলমের গতি গেলো থেমে
লেজারের উদাস পাতায়। ঝাঁকা মুটে, রিক্শা-অলা,
ফেরি-অলা আর চটকলের শ্রমিক
চমকে উঠলো শিকারির গুলিবিদ্ধ পাখির ঝাঁকের মতো।
শহরের পথে
নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে শত রক্তজবা। ছিলো যারা
সাধারণ এবং অজ্ঞাত,
যৌথ অবচেতনার পরিচর্যা পেয়ে
তারাই প্রকৃত অসামান্য হয়ে ওঠে স্বপ্নচারী পরাক্রমে
কিংবদন্তির মতো ধ্রুব এবং অপিরহার্য। ছিলো না
হেলমেট, টিউনিক ওদের, অথচ
তারাও সৈনিক রৌদ্রজলে ঝড়ক্ষুব্ধ পরিখায়।
হৃদয়ে মায়ের ডাক খুব তীব্র পৌঁছেছিলো বলে
বুকের ভেতর তার ঝড় হতে থাকে, বুঝি তাই
ছুটে আসতেই হয় পথে, হাটে-মাঠে,
শুনতেই হয় সেই গান, সুর যায় যাঞ্চা করে
আত্মবলিদান। ওড়ে তার খুলি, বুকে গর্ত হয়। কী বিস্ময়,
সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের স্মৃতির ভূগোলে
পতাকারই মতো দীপ্ত, বন্দনা-স্পন্দিত,
কেমন নিঃশব্দ প্রেমে, অথচ বাঙ্গময়!
সে নেই কোথাও
রঙিন ছবির পোস্টাকার্ডে কিংবা দেয়ালে পোস্টারে
আছে আমাদের চৈতন্যের ল্যাণ্ডস্কেপে,
গল্পে আছে, যেমন গোলাপ থাকে পাতার ভিতর,
কবিতার পবিত্র পংক্তিতে আছে, যেন
চির বরাভয়,
আছে স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের চিদাকাশে,
তাই বর্ণমালা দিয়ে আজ তার কবর সাজাই। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | কত কিছু চায়, ওদের চাওয়ার অন্ত নেই।
ওরা চায় তুমি ধুলায় গড়াও রাত্রিদিন,
নিজেকে পোড়াও, থুতু চেটে খাও, এখুনি মরো;
ওরা চায় তুমি চেকের বদলে আত্মা বেচো।ওরা চায় তুমি হাত কচলাও, ভিক্ষা করো;
ওরা চায় তুমি নিমেষে হারাও সকল খেই,
দু’হাতে কেবল ভায়ের বোনের রক্ত সেচো,
দুঃখের জমি বাড়তেই থাক সীমানাহীন।ওরা চায় তুমি নতজানু হও সর্বদাই,
ওরা চায় আজ তোমার কলমে ধরুক ঘুণ,
তোমার এমন প্রেমিক- হৃদয় ছিন্ন হোক,
শকুন-শোভিত ভাগাড় তোমার হোক ঠিকানা।ওরা চায় তুমি এক লহমায় হারাও চোখ,
তোমার ডেরায় দিন দুপুরেই চলুক হানা,
কারো ইঙ্গিতে ঘাতক তোমাকে করুক খুন,
তোমার করোটি শেয়াল পাড়ায় পাক গে ঠাই।
এত দূর এসে সত্যি বলোতো কী চাও তুমি?
যায় যাক সব, তবুও কখনো হবো না নত।কোদালকে আজো বলবো কোদাল, অকম্পিত;
দেখাবোই শাদা আলখাল্লার নোংরাগুলো।
আমার কবিতা প্রজাপতি হয়ে উড়বে প্রীত
কারো গাল ছুঁয়ে, জখমি মনের সারাবে ক্ষত;
আমার কবিতা এইতো দেখছি নীলিমা ছুঁলো,
হোক সে সকল দুঃখীর প্রিয় মাতৃভূমি। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | জাভেদ এখন তুমি ভীষণ একাকী
আবেদনপত্রের মতন ঝুলে আছো মেঘের কেশর ধরে
জাভেদ তোমার গলা ফুঁড়ে
বেলফুল ঝরে রাশি রাশি
বুকে
বিশাল চোখের মতো ঘড়িজাভেদ কখনো তুমি সর্ষক্ষেতে একজন অশ্বারোহী হয়ে
সবুজ লাগাম হাতে ছুটছো কেবল
ঘোড়ার জ্বলন্ত চোখ রণধ্বস্ত শহরের নিরালা জানালা
পা দগ্ধ মিনার আর গ্রীবা
খয়েরি গীটার
তুমি সেই গীটার আঁকড়ে ধরে অতল পাতালে
যাচ্ছো স্বপ্নবৎ মাছের সন্ধানে নাকি
তার খোঁজে যে একদা কোনো মধ্যরাতে
জলকন্যা হতে চেয়েছিলজাভেদ নিঃসঙ্গ বন্ধু হে আমার তুমি
ফিরে আসো মুঠো মুঠো হীরে জহরত
মাথায় নীলচে জলচর পাখি আর
শিশ্নে লতাগুল্ম নিয়ে তুমি ফিরে আসো
জলকুমারীর মাছরাঙা স্মৃতি তোমাকে নিয়ত ঠোকরায়তোমার জামার নাম বিষাদ জাভেদ
ট্রাউজার বিচ্ছিন্নতা গেঞ্জি বিবমিষা
তোমার জুতার ফিতা কখনো কখনো ম্রিয়মাণ
লাউয়ের ডগার মতো ঝুলে থাকেআকাশে একটি পাখি যেন
উড্ডীন পেরেক
তুমি সে পাখির তীক্ষ্ণ চঞ্চুর উদ্দেশে
অক্ষর ছিটিয়ে খুব নিরাসক্ত চেয়ে থাকো আর
পাখিটির বুকের ভেতর থেকে সজীব পাতার
মতো হাত চকিতে বেরিয়ে আসে তুমি সেই হাত
হাতে নিয়ে শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানের
নিঃসঙ্গ চূড়ায়
ঈগলের মতো বসে আছো। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ক’দিক সামলাবো আর? একটি মাত্রই ঘর, তা-ও আবার
গর্ত ফোকরময়; এদিক থেকে গন্ধমূষিক,
ওদিক থেকে ঢোকে ইঁদুর। নড়বড়ে ঘরের ছাদ ভাঙা,-
পূর্ণিমা-রাতে মেঝেতে জ্যোৎস্নার আলপনা
আর বর্ষার দিনে ঘর থৈ থৈ বিল, থালাবাসন
ভাসে পানিতে। এই ঘর নিয়ে কী আর করি? এ গর্তের
মুখ বন্ধ করতে উদ্যোগী হই তো সেই ফোকর
জলহস্তীর মুখের হাঁ। জংধরা আঙটায় ঝুলে থাকে বাদুড়।একটি মাত্র ঘরে হাওয়ার ঝাপ্টা সয়ে দু’টি পিদিম
টিম টিম জ্বলছে রুক্ষ আন্ধারে, কখন যে
দপ করে নিভে যাবে, জানি না। মাঝে-মাঝে
লক্ষ্মীছাড়া ঘরটা রক্তবমনে হয়ে ওঠে
অপ্রতিরোধ্য। গৌরী, তুমি বেহাল আমাকে শক্ত হাতে হাল
ধরতে বলো; আমি যে আর ভাঙা নাও বাইতে পারি না। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার ভেতরে আছে এক ছায়া সুনসান; তার
ধরন বেখাপ্পা খুব, অন্তরালে থাকে।
সামাজিত তাকে বলা যাবে না, যদিও ভ্রমণের
অভিলাষ আছে তার এখানে-সখানে অবিরাম।কখনও-সখনও
নিজের ছায়ার দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে
তাকাই রহস্যবাদী মানুষের মতো। সদিচ্ছার
অনটন নেই,
অথচ আমার ছায়া বাড়ালে উদগ্রীব হাত, আমার নিকট
নয়, অন্য কারো দিকে প্রসারিত হয়।সকল সময়
আমার সমান্তরাল বসে, হেঁটে যায়,
নিদ্রায় আমার সঙ্গে দিব্যি মিশে থাকে হরিহর।
যখন সে দ্যাখে ধুরন্ধর বুদ্ধিজীবী
আর গোমূর্খের দল খাচ্ছে জল একঘাটে
তুখোড় কৃপায় কারো, মর্মমূলে তার
পরিহাস ফণিমনসার রূপ ধরে। নিজস্ব ভূমিকা নিয়ে
খানিক বিব্রত হয়, ফাঁদে-পড়া
পাখির মতোই
ডানা ঝাপটাতে থাকে প্রহরে-প্রহরে। আর ভাবে
মাঝে-সাজে- কখনও প্রকৃত মানুষের চেয়ে তার
ছায়া বড় হয়ে যায়।কলহাস্য-সংকলিত সজীব বাসরঘরে মরুর বিস্তার,
গেরস্ত ঘরের উর্বশীর প্রতি যযাতি-দৃষ্টির
লোলুপতা দেখে চমকে ওঠে আর
একটি যুগের অস্তরাগে
রঙিন বিহ্বল হয়ে আমার ভেতর থেকে তীব্র
বেরিয়ে পড়তে চায়, যেন
কোনো দূর হ্রদের কিনারে গিয়ে খানিক দাঁড়াবে,
নিমেষে ফেলবে ধুয়ে অস্তিত্বের ক্লান্তিময় ধূলো।কখনও-কখনও বড় বেশি অস্থিরতা
পেয়ে বসে তাকে; আমি নিজে
যতোই ঘরের খুঁটি শক্ত হাতে ধরি,
আমার নিজস্ব ছায়া হতে চায় ততোই বিবাগী। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | দুপুর ঝুঁকে পড়ছে বিকেলের দিকে, ফেরিঅলা
হাওয়ায় আমন্ত্রণী ডাক মিশিয়ে
দাঁড়ায় মধ্যবিত্ত দরজার কাছে আর উড়নচণ্ডী এক কিশোর
লগি হাতে ছোটে কাটা ঘুড়ির পেছনে পেছনে,
কলতলায় আস্তে সুস্থে বাড়ে জটলা। ভাঙা দেয়ালে
রাঙা এক পাখি হিন্দি ফিল্মের নায়কের মতো শিস দ্যায়।
ড্রেনের ধারে কান্তিমান কুকুর
সোহাগ কুড়ায় সঙ্গিনীর।
ঢাকা, হে শহর আমার, তখন সেই মুহূর্তে,
অনেক বছর আগে একজন সদ্য যুবক
কায়েৎটুলীর রৌদ্রছায়ার আস্তানাময় গলির এক দোতলা বাড়িতে
প্রথম দেখলো তোমার পুরানো নন্দিত প্রেমিককে।
তাঁর সত্তায় তুমি ঝরিয়ে দিচ্ছিলে তোমার আলোর আদর,
তাঁর চোখে-মুখে তোমার নিঃশ্বাস আর তিনি
কেন স্বপ্ন-বিহবল সৃষ্টিতে
তাকাচ্ছিলেন আশপাশে, কী যেন খুঁজছেন। বহুকাল উজিয়ে
তিনি এসেছেন দেখতে তুমি কেমন আছো। বারবার
তাঁর চোখ একটা রুপালি জাল ছুঁড়ে দিচ্ছিলো
বাইরে, হয়তো তোমার অতীতের
কিছু শালিক কি চড়ুই ধরার জন্যে।এবং সেই সদ্য যুবক দেখছিল তাঁকে, যেমন কোনো
পরাক্রান্ত বিদ্রোহের প্রতি তাকায় ভক্ত।
যুবক জানতো, কাব্যবলায় তিনি চূড়াস্পর্শী পারদর্শী আর
গদ্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। খ্যাতি ধীমান সেই পুরুষের
পায়ে পায়ে ঘোরে শীয়ামিজ বেড়ালের মতো । পেশাদার সমালোচক,
উঠতি কবি, তুখোড় বুদ্ধিজীবী, লাস্যময়ী মহিলা,
সবাই বেজায় ভন্ ভন্ করছিলেন তাঁকে ঘিরে; তিনি
সেই মৌচাকের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও যেন সেখানে ছিলেন গরহাজির।তিনি সেই সদ্য যুবার দিকে তাকালেন একবার, এরকম দৃষ্টিতে
স্নেহপরায়ণ পিতাই তাকান তাঁর সন্তানের দিকে,
আর এ-ও এক বিস্ময়, বহুজনের মধ্য থেকে সদ্য যুবকেই
নির্বাচিত করলেন
একটি দায়িত্ব পালনের জন্যে। ধবধবে কবুতরের মতো
একটা খাম ওর হাতে দিয়ে
বললেন, ‘এটা পৌঁছে দিও’। তারপর ধরালেন
সিগারেট; ছন্দমিল, মনে হলো এক ঝাঁক
আগুনে রঙের ফড়িং আর প্রজাপতি হ’য়ে তাঁর
চারপাশে ওড়াউড়ি করছিল।সভা যখন ভাঙলো,ফিকে রক্তজবার মতো রঙ
যখন পশ্চিম আকাশে,
তখন সেই সদ্য যুবক কায়ৎটুলীর গলি ছেড়ে
পা বাড়ালো বড় রাস্তায়। এই চিঠি তাকে
পৌঁছে দিতে হবে আজই। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে
সে হয়রান-পেরেশান হলো,
কিন্তু শেষ অব্দি কিছুতেই শনাক্ত করতে পারলো না বাড়িটাকে।একটা বাড়ি মাস্তানের মতো চুল ঝাঁকিয়ে
মস্করা করলো তার সঙ্গে,
অন্য এক বাড়ি বৃদ্ধের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে
বলেন, ‘এতকাল আছেই এখানে, কই এই ঠিকানার
কথা তো শুনিনি কখনো!’
অট্রহাসি হেসে আমার উৎসাহকে ঝরাপাতার মতো
উড়িয়ে দিলো অহংকারী এক বাড়ি।
কাল অবশ্যই বিলি করবো এই চিঠি, নিজেকে আশ্বস্ত ক’রে
সেদিনের মতো সে ফিরে গেল নিজের ডেরায়।পরদিন ভোরবেলা সে গেরো অভীষ্ট ঠিকানার
খোঁজে। কী অবাক কাণ্ড, সেখানে
কোনো বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই, শুধু প্রকাণ্ড এক মাঠ
ধু-ধু করছে। মাঠে সে প্রেতাত্মার ধরনে ঘুরলো অনেকক্ষণ,
ঠিকানা ভালো ক’রে পড়ার জন্যে আবার সে চোখ বুলালো
খামের ওপর। খাম সেই মাঠের মতোই ফাঁকা,
ওতে কালি একটি আঁচড়ও নেই। তারপর
বছরের পর বছর
এক ঠিকানাবিহীন ঠিকানায়
চিঠি বিলি করা’র উদ্দেশে ক্রমাগত তার আসা-যাওয়া। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | বেশ কিছু দিন থেকে তোমার শরীর ভালো নেই,
বলা যায়, মনও ভালো নেই। শীতের রোদ্দুরে একা
বসে থাকো চুপচাপ বিষণ্ন ধ্যানীর মতো, চোখে
ভেসে ওঠে কবেকার শূন্য মাঠ, চারু পদছাপ।ঈষৎ অক্ষম বটে, অসহায় পদচারণায়;
খাতার সকল পাতা থেকে যায় অক্ষরবিহীন।
তোমার মননে পক্ষাঘাতের কামড় নেই, টান
আছে ঠিক আগেকার মতো রবীন্দ্রনাথের গানে।কখনো ছিলে না সঙেঘ, একলা সর্বদা নির্বাচিত
বান্ধবমণ্ডলে, গাম্ভীর্যের অন্তরালে হাস্যরস
বুঝি বা লুকানো থাকে, ঝর্ণা হয়ে ঝরে মাঝে-মাঝে;
দেখলে তোমার মুখ হৃদয়ে রোদ্দুর কথা বলে।আজ প্রাতঃভ্রমণে বেরুনো দায়, ঠায় বসে থাকা,
নিজের সঙ্গেই চলে বিভিন্ন আলাপ, কখনো বা
শব্দাবলী খুনসুটি করে অসাড় হাতে সাথে,
তোমার মনোজ হংস উড়ে যায় কোন সে মানস সরোবরে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আমার দুঃখের বালুচরে কাকজ্যোৎস্না দেখে তুমি
ভেবো না সুখের নাও ভিড়েছে আমার ঘাটে। দেখো,
ভালো করে দেখো, এই নিঃসঙ্গতা সঙিন উঁচিয়ে
রেখেছে আমার দিকে; বাতাসে উড়ছে বালিকণা
হা হা স্বরে, নির্জনতা নিজেই ভীষণ ভীত স্ফীত
নদীটির খল খল শব্দে, সঙ্গিবিহীন এক
চখা চক্রাকারে ওড়ে মাথার ওপর অবিরাম-
তার হৃৎকমল ছিঁড়েছে শিকারির হিংস্র ক্রীড়া।এসো না তুমিও এই বালুচরে সতর্ক পাহারা
এড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা ভাসিয়ে ময়ূরপঙ্খী নাও।
মহুয়া হবে কি তুমি আধুনিক সাজসজ্জা ছেড়ে?
নিমেষে নদের চাঁদ হয়ে আমি সাজাবো তোমাকে
আমার ব্যাকুল প্রেমে, নাকি চখী হয়ে উড়ে এসে
ডাকবে আমাকে? সেই ডাকে হয়ে যাবো ফুল্ল চখা! (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | প্রত্যাশা ছিল না কোনো, তবু যেন কে ঐন্দ্রজালিক
হঠাৎ ঘটিয়ে দিল চোখের পলকে এই সব
আশ্চর্য আমার জন্যে-এই অলৌকিক কলরব,
দুয়ারে পুষ্পক রথ, অন্তরে নিভৃত মাঙ্গলিক।
এই যে তোমার মুখোমুখি বসে আছি শীতাতপ
নিয়ান্ত্রিত ঘরে নিরিবিলি, দেবব্রত গানে গানে
মুহূর্তগুলোকে অনুপম সাজিয়ে দিচ্ছেন, প্রাণে
সুদূরের তৃষ্ণা জাগে, ঘর করে সুন্দরের জপ।যেন দিব্যনদীতীরে পেয়ে গ্যাছে ঠাঁই ভগ্নস্বাস্থ্য
এই কবি। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে করোনি বড়াই
কোনোদিন, কিন্তু আমি তোমার বাহির-অন্তরের
রূপে মুগ্ধ, ‘মাঝে-মধ্যে ছন্নছাড়া লোকটা আসতো
এখানে’, বলবে কেউ কেউ, ‘সে তো করতো লড়াই
অশুভের সঙ্গে, মুহূর্তের মুক্তো কুড়াতে সে ঢের! (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কবির জীবন নয় পুষ্পছাওয়া পথ, পেরেকের
মতো কাঁটা সর্বত্র ছড়ানো, এমনকি অগ্নিময়
পথ অতিক্রম করে তাকে বহুদূর যেতে হয়
বিপদের সঙ্গে লড়ে, অন্তহীন কায়ক্লেশ, ঢের
মনোকষ্ট সয়ে, সাপ ফুঁসে ওঠে গহন বনের
ছায়াচ্ছন্ন ছমছমে পথে আর ক্ষণে ক্ষণে ভয়
সমুখে হাজির হয় নানা রূপে। এ বিপত্তি জয়
করতে ব্যর্থ হলে তাকে টেনে নেবে কালি পাতালের।এঁদো ডোবা প্রায় ফুসফুস, মেটে রঙ কফ, জ্বর,
উচ্চ রক্তচাপ, স্মৃতিবিভ্রম ইত্যাদি নিয়ে কবি
খাতাকে পরাবে রত্নহার বারবার, এ প্রত্যাশা
অনেকের; ব্যর্থ হোক সব নিন্দুকের বাক্যঝড়
উপেক্ষায়, প্রশংসায় নির্বিকার আঁকবে সে ছবি,
অর্ফিউস-এর ছিন্ন মস্তকের গান হবে ভাষা। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কোথাও কোনও যানবাহন ছিলো না। মাইল,
মাইল হেঁটে ক্লান্ত শরীরে একটি পুরানো,
ভাঙাচোরা বাড়ির কাছে হাজির
হলাম। বাড়ির দিকে তাকাতেই গা ছমছম
করে উঠলো। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে
গা’জুড়িয়ে নেয়ার ইচ্ছার অকালমৃত্যু হলো।
আবার ভীষণ অনিচ্ছার মুণ্ডু মুড়িয়ে এগোই।
গলা শুকিয়ে কাঠ, অথচ পান করার
মতো পানি কাছে ধারে কোথাও নেই। হঠাৎ
মাথার ওপর দিয়ে একটি বাজপাখি উড়ে হয়তো
আমার দুর্দশা দেখে পাখা ঝাপ্টে হেসে অনেক
দূরে উধাও হয়ে গেলো। আজ এখানে, কাল সেখানে
এই যে আমি যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াই,
এরকম কাটবে আর কতকাল, কে জানাবে আমাকে?হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত আর কতটা
পথ পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত আস্তানায় পৌঁছুতে পারবো
ভেবে কখনও হতাশায় কালো হই, কখনও আবার
আশার তিনশত প্রদীপ জ্বলে ওঠে। এভাবে
প্রায়-মৃত শরীরটিকে টেনে হিঁচড়ে চলতে চলতে
আচনকা মন-মাতানো সুরধারা খুব নিকট থেকে
ভেসে এসে আমাকে সঞ্জীবিত করে, নতুন হয়ে উঠি। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | অন্ধকার, বড় বেশি অন্ধকার আস্তানা গেড়েছে
চারদিকে। খুব কাছের বস্তুও
এখন যাচ্ছে না দেখা। সম্মুখে এগিয়ে
যেতে গেলে কী যেন কিসের
হোঁচট পেছনে ঠেলে দেয় এই বিব্রত আমাকে
কিয়দ্দূরে। নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক পথ খুঁজে নিতে চাই।‘কে তুমি এমন বিরানায় আমাদের
আস্তানায় তস্করের মতো
গোপনে পড়েছো ঢুকে?’ ভীষণ ভড়কে গিয়ে কথা
বলবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি আর
অদৃশ্য ব্যক্তির অবয়ব খুঁজে খুঁজে ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে
পাথুরে মূর্তির মতো হয়ে থাকি।কে আমাকে বলে দেবে কতদূর গেলে খাঁটি কোনও
মানুষের দেখা পাবো? এখন আমার
আশেপাশে খল, ভণ্ড আর ষোলোআনা স্বার্থপর
লোক আসা-যাওয়া করে। যে গাছকে ছায়াময় ভেবে
ঠাঁই নিই ওর নিচে, নিমেষেই সেটি উবে গিয়ে
এক রাশ কাঁটা হয়ে আমাকেই কামড়াতে থাকে।ছুটতে ছুটতে শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে এ কোথায়
এসে পড়লাম সন্ধ্যাবেলা? আশ্রয়ের
এক রত্তি চিহ্ন নেই, শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতা আমাকে
ত্বরিত গ্রাসের বাসনায় ক্রমাগত জিহ্বা চাটে।তাহ’লে আখেরে, হায়, এই কালবেলায় কোথায়
বিশ্বাস্ত আশ্রয় পাবো খুঁজে? কে আমাকে
বুকে টেনে নিয়ে সুমধুর কণ্ঠস্বরে
বলবে, ‘বান্ধব, ভয় পেও না, এখানে ঠাঁই নেই ঘাতকের। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কখনো মৃত্যুই শ্রেয় মনে হয়; এই বেঁচে থাকা
বুকে পেসমেকার বসানো প্রৌঢ়বৎ নিরর্থক।
নিজেকে প্রত্যহ দেখি তীক্ষ্ণতায় আপাদমস্তক
ঝানু রেফারির মতো; ঘেন্না ধরে, সবকিছু ফাঁকা,
ফাঁপা, ঢোলা, যেন বালিশের ওয়ার বেঢপ; বাঁকা
চোখে দ্যাখে অনেকেই। বুঝি বা দ্রাবিড় যুগে ত্বক
ছেড়ে যৌবনের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরময়তা পলাতক;
মৃত্যু তার ন্যায্য অধিকার ক্রমশ করছে পাকা।এখনো রয়েছি লিপ্ত যুদ্ধে অনিচ্ছায়। শক্তিধর
শক্ররা ছুঁড়ছে নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র অবিরত,
আমার নিজস্ব অবস্থান জেনো তবুও অনড়।
কী আশ্চর্য, কখনো খড়িশ শক্র, কখনো বা চেনা
বান্ধব সাজায় ব্যুহ একযোগে। বিভ্রমবশত
ভাবি হয়তো এই রক্তপায়ী যুদ্ধ আর চলবে না। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আমার জানালা থেকে দেখি লক্ষ লক্ষ মৃত পায়রা
স্তূপ হয়ে পড়ে আছে চৌদিকে। পাঁচ নিনিটে পাঁচ হাজার
ঝকঝকে মোটরকার গুঁড়িয়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনায়।
একটা অগ্নিকুন্ডের ভেতরে পুড়ছে
পলাশী, নবাব সিরাজন্দৌলার মুকুটে
সূর্যাস্তের রক্তবমি ঝলসে ওঠে বারংবার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তাড়া তাড়া নোট
এক ঝাঁক ক্রুদ্ধ পাখি হয়ে ঠোকরাচ্ছে পথচারীদের;
হাজার হাজার কাঠমোল্লার আকাট হৈ হল্লায়
ডুবে যাচ্ছে প্রগাঢ় উচ্চারণ। শক্তিশালী কবিসংঘ
অষ্টপ্রহর মেতে রয়েছে বাথরুমের দরজা-জানালা, পাইপ,
বেসিন আর কমোড সারাবার কাজে এবং
কুকুরের পাল কবিতা উগরে দিচ্ছে মধ্যরাতে।
রাজনীতিকগণ কুসীদজীবীর কাছে সত্যকে বন্ধক রেখে
মজেছেন ফটকাবাজারের তেজিমন্দিতে।
স্বর্গতন্ত্রের দোহাই পেড়ে
মৃতেরা সোৎসাহে কবর গিচ্ছে জীবিতদের!
ডালের বাটিতে মরা মাছির মতো ভাসছে একদা-সুখী গ্রাম,
বিস্কুটে কামড় দিতে গিয়ে মনে হয় দুঃস্বপ্ন চিবুচ্ছি
আর আমার উদরে ঘুন্টি-অলা গলা ঢুকিয়ে দ্যায়
ইমরুল কায়েসের উট,
যে মেয়েকে চুমো খেতে যাই, তারই মুখে নিমেষে
গজিয়ে ওঠে ফণিমনসার বন,
বাহুমূলে পুরনো উইঢিবি।
খুনখারাবির কাল এখনো হয়নি শেষ, এদিকে
আহত মুক্তিযোদ্ধার বিবর্ণ ক্রাচে ধরেছে ঘুণে।এবং নবাব সিরাজন্দৌলা করতলে
নিজের কাটা মস্তক নিয়ে আর্তনাদ করতে করতে ক্রমাগত
হোঁচট খেয়ে চলেছেন বাংলাদেশের নতুন মানচিত্রে। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | শোনো হে তোমাকে নিয়ে ভারি মুশকিল।
এখনো সুস্থির হ’য়ে গুছিয়ে-গাছিয়ে সব সময়মাফিক
কিছুতেই বসতে পারলে না। এখনো হঠাৎ ঢিল
ছুঁড়ে দাও মগডাল, পুকুরের সবুজাভ জল লক্ষ্য করে
কিংবা দাও শিস পথে হেঁটে যেতে ঠিক
চঞ্চল যুবার মতো। এখনো তোমার মৌন রক্তের ভিতরে
এক ঝাঁক পাখি গান গেয়ে ওঠে যখন তখন,
প্রেমিকার খুব কাছে থাকবার জন্যে, কী-যে হয়,
আজো ছোঁক ছোঁক করে মন
এবং তোমার সত্তা জুড়ে নামহীন এক ব্যাকুলতা রয়।শোনো হে তোমাকে নিয়ে ভারি মুশকিল।
একদিন চিঠি বিলি না করলে ডাকপিয়ন, তোমার মধ্যে
জেগে ওঠে ছটফট একটি মানুষ আর এখনো দুয়ারে এঁটে খিল
ঘরময় করো ক্ষিপ্র পায়চারি, শূন্য পাতা পদ্যে
ভরে না উঠলে সুখ সর্বদা তোমার সাথে দেয় আড়ি, তুমি
নিষ্ফল ক্ষেতের মতো পড়ে থাকে একা শুকনো ডাল,
খড়কুটো, মরা শালিখের স্মৃতি নিয়ে। কেমন রহস্যময় জলাভূমি
তোমাকে কেবলি ডাকে, তুমি ফের হয়ে যাও অস্থির, মাতাল। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | বলতে ভাল লাগে, আমার পূর্বপুরুষগণ
মেঘনা নদীর তীরবর্তী পাড়াতলী গাঁয়ের
বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের ছোট বড় কুঁড়ে ঘর
এখন নিশ্চিহ্ন, কিন্তু পুকুর আর পাকা মসজিদটি
আজ অব্দি রয়ে গেছে সগৌরবে। আমার
পিতার সৃষ্ট একটি দালান আর ইশকুল এখনও
দাঁড়ানো মাথা উঁচু করে। দু’তিন বছর অন্তর
আমরা একবার যাই পূর্বপুরুষদের স্মৃতির মঞ্জিলে।দাদাজান, নানাজান, আব্বা আর চার চাচা, আমার
এক সন্তানের এবং আরও কারও কারও কবর রয়েছে সেখানে। রাত্তিরে
নিষ্প্রদীপ সেই উদাস কবরস্থানে জোনাকিরা ছড়ায় আলো
আর ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা সুর হয়ে ঝরে চৌদিকে।
পূর্বপুরুষদের কদিমি পুকুর আত্মজকে আমার
গিলেছে সেই কবে। এক ভরদুপুরে। আজও স্বগ্রামে গেলে
অতীত এবং বর্তমানের প্রতি নির্বিকার পুকুরটির কিনারে
গিয়ে বসি। গাছ গাছালি ঘেরা এই
জলাশয় সাক্ষী, এখানেই একাত্তরে হিংস্রতার তাড়া-খাওয়া
সন্ত্রস্ত হরিণের মতো জন্মশহর থেকে ছুটে এখানেই
নিয়েছিলাম ঠাঁই। এই পুকুর আমাকে দেখলেই, মনে হয়,
হাসে বাঁকা হাসি; তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার।
আমাদের পাড়াতলী গাঁয়ে ইলেকট্রিসিটি এখনও
গরহাজির, অরণ্যের ঘোর অন্ধকার
বিরাজমান এখানকার রাতগুলো। নিশীথের
তিমির রোদেলা দুপুরেও অনেকের মনের
ডোবায় ভাসমান, অথচ গাভীর ওলান
থেকে নিঃসৃত দুধের ধারার মতোই সারল্য ওদের।শহরে লালিত পালিত এই আমার সত্তায় পাড়াতলী গাঁয়ের
পূর্বপুরুষদের শোণিতধারা প্রবহমান
মেঘনার স্রোতের মত। বুঝি তাই সমাজের বহুমুখী নিপীড়ন,
নির্দয় শাসকদের সন্ত্রাস আমার ভেতর
মেঘনার উত্তাল তরঙ্গমালা হয়ে জেগে ওঠে প্রতিবাদ,
এগিয়ে চলার তেজ, প্রতিক্রিয়ার অনড় তট ভাঙার জেদ। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | নাটক চলছে সগৌরবে আর দর্শকে দর্শকারণ্য, তিল
ধারণের ঠাঁই নেই কোনোখানে। কুশীলবদের অবয়ব
দৈত্যমার্কা নয়, যমদূত নয় ওরা, বাস্তবিক
মাটির মানুষই বলা চলে। দৃশ্যে আছে কিবা নেই,
বোঝা দায়। উইংস-এর আড়ালে নিপুণ
নেপথ্য-কথক অনর্গল আওড়ায় বাক্য বাক্যাংশ এবং
সেই মতো নানা কুশীলব কী যে বিড়বিড় করে প্রতি অঙ্কে।
দৃশ্য আছে ঠিকঠাক, অথচ তেমন নাটকীয়তাই নেই।আমিও দর্শক এই নাটকের। জড়োসড়ো, বোকা ভঙ্গিমায়
আছি এক কোণে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি মেলে। কখবো না
চোখ বুজে থাকি, শুনি, বলে কেউ-নাটকটা মজাদার বুঝোছা বান্ধব?
প্রতি পদে ত্র্যাকশন দেখছো না? বিষম রোমাঞ্চকর লাগে।
নাটকের বিষয় বাস্তবধর্মী চমৎকার, মানে হত্যা।
রূপক প্রতীক নেই, ব্যাপারটা খোলামেলা খুবই।এ নাটকে আগাগোড়া প্রতিটি দৃশ্যেই মনোহর
নানান খেলার সাজে হত্যা করে পায়চারি। কখনো সে করে
নান্দীপাঠ, কখনো বা ভূমিকা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়
নৈপুণ্যে বাড়ায় হাত, পিয়ানো বাজায়, মোমগন্ধী সুরে গায়
গান, ছড়ি নেড়ে নেড়ে স্বগত ভাষণে ওঠে মেতে,
মাথায় টুপিটা খুলে নিয়ে করে বাউ। হত্যা যেন
ফুরফুরে চড়ুইভাতি চৌরাস্তায় কিংবা বন-বাদাড়ে, টিলায়।কখন যে গুলি কার খুলি চকিতে উড়িয়ে দেবে,
শীতল মাথায় কে বা খুন করতে করতে হেসে হবে খুন ,
পড়বে লুটিয়ে কৌচে অথবা ভায়ের
বন্ধুর গরম ঝটিতি রুমালে মুছে নিয়ে
গুনগুনিয়ে ফিরবে নিষিদ্ধ আস্তানায় ট্রালা লালা-
সঠিক যাবে না বলা। এ নাটকে হত্যা মানে চৈত্রে কি আশ্বিনে
বিকেলে পুকুর পাড়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরা অথবা ফুলের
পাপড়ি কিংবা গাছের সবুজ পাতা ছেঁড়া,
দাঁতে ঘাস কাটা।এ নাটকে কুশীলব যখন তখন ছোঁড়ে পিস্তল, বন্দুক,
যেমন বালক সুখে বাগিয়ে সাধের টয় গান
যথেচ্ছ ট্রিগার টেপে। রুমাল চাপে না কেউ চোখে,
হেসে যাচ্ছে গড়াগড়ি; দর্শকেরা দেয় তালি কী উল্লাসে!
আমিও কি তাদের সামিল হবো? নিজের অজ্ঞাতে
তুমুল বাহবা দেবো পাত্র-পাত্রীদের? নাকি দ্রুত
সিট ছেড়ে চলে যাবো? লতার আড়ালে যাবো অলক্ষ্যে সবার
অথবা খুঁড়বো গর্ত, তুলবো মিনার? কিংবা নাট্যকার সমীপে ব্যাকুল
হাঁটু গেড়ে করজোড়ে করবো নিবেদন-নাটকের
বিষয়টা আগাগোড়া পাল্টে দিন হে দ্রষ্টা, হে স্রষ্টা দয়াময়! (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কখন যে কী ক’রে তারার মতো জ্বলজ্বল করে
শব্দমালা খাতার পাতায়, যায় না
ঠিক বোঝে। সেই শব্দগুচ্ছ আখেরে
পরিণত হয় পুরো কবিতায়। কখনও কখনও দেয়ালে
মাথা কুটে মরলেও হায় কবিতার ছায়া
বিন্দুমাত্র হয় না দৃষ্টিগোচর। কপাল-চাপড়ানোই সার।কখনও কখনও তুমুল আড্ডায় ব’সে থাকি
যখন, হঠাৎ কবিতা ঝলসে ওঠে চিত্তে
দু’তিনটি শব্দ নিয়ে। আড্ডার দৃশ্য দৃষ্টি থেকে
মুছে যায়। চতুর্দিকে কতিপয় শব্দ নর্তকীরূপে
প্রস্ফুটিত হয় খাতায়। হে কল্পনা, হে সাধনা
আমাকে ভীষণ পথে নিয়ে যাও ক্ষতি নেই। সব দিক দেখে নিতে চাই।
ইচ্ছে করলেই দেখা যায় কি সকল আকাঙ্ক্ষিত
দ্রষ্টব্য কখনও? সম্ভবত নয়, মৃত্যু মুছে ফেলে
ঢের সুন্দরের চিত্রমালা দৃষ্টি থেকে, শুধু কিছু
হাহাকার থেকে যায় বাগানে, গলিতে,
বারান্দায়। কখনও কখনও তোমাদের মাঝে যারা
কাব্য ভালোবাসো তারা হয়তো আমাকে ভালোবাসো। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | আমিতো অজস্র কবিতার মৃত্যুশোক পুষে রাখি,
মৃত্যুশোককালীন আঁধারে নির্বিকার ফেরেস্তারা
দ্যাখেন আমার মদ্যপান। মদিরার স্বচ্ছ ধারা
আমার ভেতরে বয়ে গেলে পর নিজেকে একাকী,
ব্যথিত একাকী লাগে আরো, চুপচাপ বসে থাকি,
কখনো চড়িয়ে গলা এলেবেলে কথা বলি, যারা
আশপাশে থাকে, তারা নিজেরাও নয় বাক্যহারা;
আমার চোখের ভুল দ্যুতিতে কেউবা পড়ে ফাঁকি।কবিতার মৃত্যুশোক ফিকে হলে নিভৃত টেবিলে
কাগজ কলম নিয়ে বসি। অকস্মাৎ চোখে স্মৃতি
ভেসে ওঠে, যেন শান্ত জলের উপরিভাগে সদ্য
মৃত মাছ। কখনো আমার অস্তিত্বের গূঢ় নীলে
খৃষ্টপূর্ব সভ্যতার মতো কিছু প্রবল প্রতীতি
নিয়ে জেগে উঠতে চায়, বুঝি ওরা অলৌকিক পদ্ম। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | রাতে চাঁদটা হঠাৎ যেন বেজায়
বেঁকে বসল। বলা যেতে পারে, মেজাজ তার হয়তো
অকারণেই বিগড়ে গেছে। হয়তো
এখনই সে ছিটকে মিলিয়ে যাবে জলের ঢেউয়ে।হঠাৎ আকাশটাকে কেন যেন বেখাপ্পা
ঠেকছে। বস্তুত যেন আকাশকে কেউ ভীষণ
চড় কষিয়ে তার সৌন্দর্যকে নির্দয়ের ধরনে
ধ্বংস করে ফেলেছে। যে-জলাশয় আমার অনেক
সময়কে সাজিয়ে দিয়েছে বিচিত্র সব
চিত্রের আবদানে তার এই বর্তমান চেহারা
কেন জানি আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছি না।
কোনও মুহূর্তেই। এই জলাশয় ছুঁতে পারছি না কিছুতে।তবু কেন যেন আমি প্রায়শ এই জলাশয়ের
কাছে চলে যাই কখনও ভোরবেলা, কখনওবা
জ্যোৎস্নারাতে; কখনও কখনও ছুঁই তার করুণ
জলরাশি। কিছুতেই তার আকর্ষণ পুরোপুরি ছুড়তে
পারি না বাতিলের নর্দমায়। এত অপছন্দের পরেও
তার দিকেই তাকাই তাকে এত আকর্ষণীয় কেন যে মনে হয়!ভাবি কখনও আর যাব না কিছুতেই
সেই বিচ্ছিরি জলাশয়ের কাছে নষ্ট করতে
সময়। কী লাভ ক্ষণে-ক্ষণে বেহায়া ব্যাঙের
লাফ দেখে, পচা জলরাশির দুর্গন্ধ শোঁকা?
প্রতিজ্ঞা করি কখনও এদিকে পা ফেলব না কিছুতে,
অথচ বেলা অবেলায় চ’লে আসি; শুনি বাঁকা হাসি! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | এ শহরে জীবিকা সর্বত্রগামী; ছোট বড় সব
চাকুরে, টাউট, উচ্চাকাংক্ষী ধনবান, ভিখারীর
ভিড়, শীতরাতে অতি ব্যবহারে জীর্ণ, শীর্ণকায়
রঙিন গণিকা, গঞ্জনায় অভ্যস৫ত খঞ্জের জন্যে
আয়ের নানান পথ খোলা। বেশ কিছু বেকার যুবক
মাস্তানের দঙ্গলে সহজে ভিড়ে যায়। যত্রতত্র
ধর্মের ব্যবসা জমে ওঠে; নীতিবিবর্জত ফাঁপা
রাজনীতি, বাণিজ্যিক সভ্যতার মরু বেড়ে চলে।এ শহরে কোনোদিন কোকিলের ডাক শুনে অকস্মাৎ
থমকে দাঁড়াই ফুটপাথে। শ্যামলীর এ মলিন
গলিতেও গোলাপের চাষ হয়, কোথাও কোথাও
প’ড়ে থাকে বুগেনভেলিয়া। সর্বোপরি আমাদের
দু’জনের অপরূপ মানবিক ভালোবাসা ধু ধু
শহরকে বাঁচাবে নিশ্চিত মরুভূর গ্রাস থেকে। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আখেরে দক্ষিণ বাংলার সুদূর গ্রাম থেকে
এল সেই চিঠি, যার জন্যে প্রতিদিন
ডাকবাক্স খুলেছি দু’ বেলা
বালকের পাখির বাসা হাতড়ানো অধীরতায়।চিঠিটা অনেক আগেই
পৌছুনোর কথা, অথচ এল
অনেকদিন পরে,
যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী
পাড়ি দিয়ে এসেছে। চিঠিটাকে
লুকিয়ে চুমু খেলাম
বার বার, বলা যায়,
মহাসমারোহে।সেই চিঠিতে তোমার কার্পণ্যের কাঁটাগুলো
আমাকে খোঁচালো অনেকক্ষণ।
আনন্দে লাফিয়ে উঠবো নাকি
ব্যথিত মুখে বসে থাকবো,
মনস্থির করা গেল না কিছুতেই।
আমার জখমি হৃদয় লাগাবার মতো মলম
কোথাও নেই ভেবে
নিশ্চুপ বসে থাকলাম।তোমাকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয়,
লিখেছো তুমি।
কীসের ভয়? কেন ভয়? তার
কোনো উল্লেখ কিংবা ইঙ্গিত ছিল না কোথাও।
বাক্যটি নেড়ে চেড়ে দেখার সময়
দৃষ্টি পথে ঝিকিয়ে ওঠে আমার অতীত এবং বর্তমান।মনে পড়লো আম্র মেহমান নেওয়াজ
মরহুম আব্বার কথা।
আমাকে তিনি তাঁর দরাজ সরাইখানার
একজন অতিথি
বলেই ভাবতেন।
আমাদের পুরানো বাসায় কখন আসি আর
কখনই বা বেরিয়ে যাই,
তিনি ঠাত্তর করতে পারতেন না
সহজে। আমাকে ঘিরে তাঁর
স্বপ্নগুলো ক্রমাগত গুঁড়িয়ে
যাচ্ছিল বলে আমাকে নিয়ে
ভারি ভয় ছিল আব্বার।ছোটবেলায় আমি যখন ছটি ঘরে,
তখন আমার একটা মারাত্মক অসুখ
হয়েছিল; বাঁচার আশা ছিল না এতটুকু,
সেই তখন থেকেই
আমাকে নিয়ে আম্মা যে ভয়
পেয়েছিলেন, এখনো, এত বছর পরেও তা কাটেনি।আমার গৃহিণীরও আমাকে নিয়ে বড় ভয়।
পাখিও বাসা বানায়,
অথচ আমাকে দিয়ে এখনো তা হয়নি।
যার মন এমন উডু উডু, যে চাকরির পোক্ত তরী
কুলে ভেড়ার আগেই স্বেচ্ছায় তড়িঘড়ি ডুবিয়ে দেয়,
তার বিষয়ে ভয় কখনো যায় না অস্তাচলে।আমার যাঁরা শুভাথী, তাঁরা
আজকের আমার শরীর সম্পর্কে সারাক্ষণ
ভয়ে ভয়ে থাকেন,
পাছে হঠাৎ একদিন সটান
তাঁদের কাঁধে চড়ে
পৌঁছে যাই গোরস্তানে।যেসব কবি ঈর্ষা করেন আমাকে,
তাঁদেরও ভারি ভয় আমাকে নিয়ে,
পাছে তাদের খ্যাতির টগবগে ঘোড়াকে
ডিঙিয়ে আমাকে উড়িয়ে
নিয়ে যান বহুদূরে যশের ফেরেশ্তা।
শক্রপক্ষ খামখাই আমার ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে
আমাকে ধরাশায়ী করার বড়াইয়ে ফেটে পড়েন।এবং আমাকে নিয়ে স্বৈরাচারী সরকারেরও বড় ভয়।
কখন আমার কলম বেমক্কা উগরে দেয়
ওদের ভিতটলানো পংক্তিমালা,
ওরা তা নিয়ে ধন্দে থাকে দিনভর, রাতভর! (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | যাচ্ছিলাম একা সুনসান অচেনা রাস্তায় । হঠাৎ
কোত্থেকে ক’জন ডাকাবুকো লোক আমার
ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ
টুঁটি চেপে ধরে আমার, কারও মুঠোয়
বন্দি আমার মাথার উস্কো-খুসকো চুল
আর অন্য একজন ক্রমাগত মারছে লাথি।মগের মুল্লুক না কি? কেউ কি নিজের উন্মশহরে
নিরাপদে পথে হেঁটে চলতে
পারবে না? তাকে কি গুণ্ডাদের খঞ্জরের আঘাতে
মুখ থুবড়ে পড়তে হবে খোলা রাস্তায়? জ্যোৎস্নাস্নাত
পথ কি রঞ্জিত হবে নিরপরাধ, কারও সাতে, পাঁচে
না-থাকা, নিরামিষ ধরনের ব্যক্তির রক্তধারায়?কখনও কখনও মনে হয়, আমার প্রিয় শহর
এই ঢাকা রত্নপুরী, এখানে
নগরবাসী সবাই উত্তম চরিত্রের অধিকারী,
প্রত্যেকেই ধীমান, শিল্পকলা-চর্চায় মনোযোগী। কখনও
কখনও কবিমেলা অনুষ্ঠিত হয় অপরূপ উৎসবের
ধরনে, সংবাদ যার রটে যায় দেশ-দেশান্তরে।এই স্বপ্ন, এই অভিলাষ অর্ধসত্য হয়ে রয়
কারও কারও চেতনায়, কেউ কেউ
খেলাঘর ভেঙে গেলে বেদনার্ত চিত্তে কবিতা রচনায়
মাতাল হয়ে খাতার পাতা কখনও নিরাশায়, কখনও-বা-আশায়
বাংলা বর্ণমালার রূপ নানা সাজে সাজিয়ে
আসমানের মেঘে, বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে ভাসায়। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কে আসে এমন ধু ধু অবেলায় আমার নিবাসে?
জীর্ণ শীর্ণ আমার নিবাসে
কে আসে তীক্ষ্ণ ক্ষুধার্ত চোখে? করে না তেমন পীড়াপীড়ি কিছু,
চায় না কিছুই, নগ্ন সিঁড়িতে বসে থাকে একা,
বসে থাকে একা,
বসে থাকে একা।
বসে থাকে একা।উস্কো খুস্কো চুলের ভেতরে স্বপ্ন বুঝিবা হরিণের মতো
করে ছোটছুটি। সরু আঙুলের ডগায় জমেছে স্মৃতির অভ্র।
এখানে আসার কথাই ছিল না। এই লোকালয়,
ফুটপাত, গলি কমলালেবুর স্নেহপরায়ণ
রঙ, শহরের দুঃস্থ বুড়োটে বাজিকর আর খাঁচার ময়না।
ছেড়ে ছুড়ে কবে চলে গিয়েছিল; তবু সে এসেছে
ফিরে উদাসীন। চোখের কিনারে রঙ-বেরঙের
পাখি মরে যায়,
পাখি মরে যায়,
পাখি মরে যায়।নিজেকে বন্দি রেখেছে বাক্যের জালে।
মুক্তির গান শুনে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়তে চাইলে দ্যাখে সে
জালের সীমানা বাড়তেই থাকে মোহের বুননে
বাড়তেই থাকে,
বাড়তেই থাকে,
বাড়তেই থাকে।
একদা ছিলাম সতেজ যুবক, একদা আমার দিনের অশ্ব
ছুটেছিল কত খোলা প্রান্তরে বালিয়াড়ি আর
গিরি-সংকটে, ক্ষুরের ঝিলিকে মুগ্ধ সবাই।
এখন এইতো ছেঁড়া খোঁড়া আমি, অবসাদ-ছাওয়া।
মনে বসে আছি, দুঃখের সাথে ভাগাভাগি করে
নিজেকে; দু’বেলা করছি আহার, নিজেরই রক্তে ওজু সেরে ফেলি
তীব্র খরায়, বকুল এখন ফুটলো কোথায় ইত্যাদি কথা
বলে সে হঠাৎ নিশ্চুপ হয়। অলক্ষ্যে তার বুকের ভেতরে
বুক ভেঙে যায়,
বুক ভেঙে যায়,
বুক ভেঙে যায়। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | আমার কবিত্ব বুঝি গৃহত্যাগী সিদ্ধার্থের মতো
বড় অনশন-ক্লিষ্ট আজ, নইলে কেন হে নবীনা
তোমার রূপের শিখা অনায়াসে জ্বালতে পারি না
ছত্রে ছত্রে? এই চোখ, এই ওষ্ঠ আর সমুন্নত
নাকের উপমা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হচ্ছি অবিরত।
নতুন উপমা পেলে অবশেষে হে তুলনাহীনা,
তা-ও বড়ো তুচ্ছ মনে হয় আর মগজে যে বীণা
বাজে মাঝে-মাঝে, তারও সুর কাটে, চেতনা বিব্রত।আমার এ প্রয়াসের ব্যর্থতায় জানি উপহাস
জুটবে বিস্তর আর কবিত্বকে সুতীক্ষ্ম ধিক্কার
দেবে কেউ কেউ। তুমি যেন রূপবতী বাংলাদেশ
অনন্য সৌন্দর্যে খুঁতে, অন্তরঙ্গ একটি নিশ্বাস,
এবং বর্ণনাতীত। খুঁজিনাকো উপমা তোমার
শুধু দেখি, দেখি মুগ্ধাবেশে তোমাকেই অনিমেষ। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এখানে দরজা ছিল, দরজার ওপর মাধবী
লতার একান্ত শোভা। বারান্দায় টব, সাইকেল
ছিল, তিন চাকা-অলা, সবুজ কথক একজন
দ্বারবন্দি। রান্নাঘর থেকে উঠতো রেশমী ধোঁয়া।মখমল গায়ে কেউ, এঁটোকাঁটাজীবী, অন্ধকারে
রাখতো কখনো জ্বেলে এক জোড়া চোখ। ভোরবেলা
খবর কাগজে মগ্ন কে নীরব বিশ্ব-পর্যটক
অকস্মাৎ তাকাতেন কাকময় দেয়ালের দিকে।ভাবতেন শৈশবের মাঠ, বল-হারানোর খেদ
বাজতো নতুন হয়ে। মুহূর্তে মুহূর্তে শুধু বল
হারাতেই থাকে, কোনো হুইসিল পারে না রুখতে।
ক্ষতির খাতায় হিজিবিজি অঙ্কগুলি নৃত্যপর।এখানে দরজা ছিল, দরজায় ওপর মাধবী
লতার একান্ত শোভা। এখন এখানে কিছু নেই,
কিচ্ছু নেই। শুধু এক বেকুর দেয়াল, শেল-খাওয়া,
কেমন দাঁড়ানো, একা। কতিপয় কলঙ্কিত ইট
আছে পড়ে ইতস্তত। বাঁ দিকে তাকালে ভাঙাচোরা
একটি পুতুল পাবে, তা ছাড়া এখানে কিছু নেই।ভগ্নস্তূপে স্থির আমি ধ্বংসচিহ্ন নিজেই যেনবা;
ভস্ম নাড়ি জুতো দিয়ে, যদি ছাই থেকে অকস্মাৎ
জেগে ওঠে অবিনাশী কোনো পাখি, যদি দেখা যায়
কাবুর হাসির ছটা, উন্মীলিত স্নেহ, ভালোবাসা। |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | গৃহকোণে খাটের ওপর সাবলীল শুয়ে থাকে
আমার বিছানা সারাক্ষণ। যদি কেউ ভালো করে
চোখ রাখে বিছানার ওপর, তাহলে শহজেই
নজরে পড়বে তার বাদামি চাদর, ফুল-তোলা;
চারটি বালিশ বেশ নরম এবং ঝকঝকে।
মশারি খাটানো হয় রাত্রিবেলা, পায়ের নিকট
শীতকালে নিভৃতে গোটানো থাকে লেপ। বেড়ালের
সঙ্গ ছাড়া বিছানার নেই কোনো প্রকাশ্য বাহার।আমার গৃহিণী রোজ বিছানার পরিচর্যা করে
খুশি হন। কখনও চড়ই বিছানায় খড়কুটো
ফেললে তিনি ছুটে এসে সরিয়ে ফেলেন আবর্জনা,
মৃদু গালমন্দ দেন পাখিদের। শয্যা রচনায়
আমার কৃতিত্ব নেই একরত্তি। শুধু আমি কিছু
প্রতীক এবং চিত্রকল্পে সাজাই বিছানাটিকে। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আর নয়, অন্য কিছু নয়, এবার দাঁড়াও ঘুরে,
জুতে নাও ধনুকে অব্যর্থতীর। দেখছো না ধেয়ে
আসছে চৌদিক থেকে হন্তারক দল? রক্তপায়ী
বাদুড়ের ঝাঁক ঝুলে আছে ভরসন্ধেবেলা, চোখ
পুড়ে যায়, মিত্র ভেবে শক্রকেই ধরেছো জড়িয়ে
বার বার, মৈত্রীর সহজপাঠী ভুলে বসে আছো।
পদতল থেকে দ্রুত মাটি স’রে যাবার আগেই
পূর্ণ বেগে ছোটাও দূরন্ত অশ্ব, হানো শত বাণ।যুদ্ধে ক্লান্তি আছে, ব্যেপে-আসা বিষাদ, শূন্যতা,
বুকফাটা ক্রন্দনের রোল শুনে হাত থেকে খ’সে
পড়বে ধনুক হয়তো, এবং ফেরাতে পারো মুখ
রক্তঝরা গোধূলি-আকাশ থেকে। যারা মৃত বহু
আগে, তারা যদি আজ তোমার হাতেই মৃত্যু পায়,
তাহ’লে কোরো না খেদ, শুধু ঘুরে দাঁড়াও এবার। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কেমন প্রেমিক আমি? বহু দীর্ঘ বছরের পর
এ প্রশ্ন তুলছে মাখা অন্ধকার মনের বিবরে।
তুমিও আমার প্রতি, হায়, তারাও এমন ক’রে
আজকাল মাঝে-মাঝে, মনে হয়, প্রশ্নের উত্তর
একান্ত জরুরি- নইলে একটি দেয়াল নিমেষেই
ভীষণ দাঁড়িয়ে যাবে আমাদের মধ্যে। হয়তো ভাবো
কোনো কোনো বিক্ষুব্ধ প্রহরে, আমি কী এমন পাবো
এই খাপছাড়া লোকটার কাছে বস্তুত যা নেইঅন্যের আয়ত্তে আজ? প্রেমিকের গুণাবলী কী-যে
জানি না সঠিক কিছু, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
যখন আমাকে দ্যাখো তুমি, আমার হৃদয়ে বাঁশি
বেজে ওঠে, চোখে জাগে নতুন সভ্যতা, দীপ্র বীজে
ধনী হয় মনোভূমি। তোমারই উদ্দেশে দুটি হাত
বাড়াই, আবার থামি, পাছে করো ঘৃণা অকস্মাৎ। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | একটা লোক নিয়মিত আমার বাড়ির দিকে
আড়চোখে খানিক তাকিয়ে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে
খোলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। অবাক কাণ্ড,
সে যখন যায়, তখন গলিতে কাছে ধারে
কাউকে আমি দেখি না; এমন জনশূন্যতা রোজ কী করে হয়,
ভেবে পাই না। লোকটার হাতে কিংবা ঠোঁটে জ্বলন্ত
সিগারেট দেখিনি কোনোদিন; মৃদু হাসির রেখাও
ফোটেনি মুখে কখনো, শুধু পাথুরে কাঠিন্যের প্রাধান্য।লোকটা আমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে,
যখন আমি যে কাজই করি-চুপচাপ বসে থাকি, বইয়ের
পাতা ওল্টাই, চিঠি লিখি, কবিতার খসড়া তৈরি করি,
অথবা চা খাই, আমার গায়ে কাঁটা দেয়,
হাত-পা কেন জানি হিম হয়ে আসে, চোখের পিদিম নিভে যেতে চায়;
লোকটা যেদিন এ-পথে হাঁটবে না, সেদিন আমি থাকব না। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | সকলেই চলে গ্যাছে, বলা যায় পৌঁছে গেছে ঠিক
নির্দিষ্ট গন্তব্যে, শুধু আমি এই দম আটকানো
রুদ্ধ এলাকায়
দাঁড়ানো ভীষণ একা। কথা ছিল যাবো, নিশ্চয় আমিও
যাবো
সকলের সঙ্গে, কিন্তু আমি বড় বেশি দেরি করে
ফেলেছি নিশ্চিত।
ওরা কেউ পথে কোনো কিছু দেখে, মানে
রূপ-শোভা দেখে দাঁড়ায়নি
একদণ্ড থমকে কোথাও।ওরা চলে গেছে, লক্ষ্য স্থির রেখে সময় মাফিক।
অথচ স্বভাবদোষে আমি
বস্তুত পথের মোড়ে থামিয়েছি গতি বারে বারে,
কাটিয়ে দিয়েছি বেলা ঘাসফুল আর হরিণের
কী স্নিগ্ধ বিশ্রাম দেখে এবং সত্তায় মেখে সূর্যোদয় আর
নিশ্বাসে গভীর টেনে বৃক্ষঘ্রাণ। কখন যে দলছুট হয়ে
পড়েছি পাইনি টের। এখন আমার
চৌদিকে দেয়াল শুধু নীরন্ধ্র দেয়াল, কোনো দিকে
পথ খোলা নেই এতটুকু। ইতস্তত
ছুটছি ভীষণ এলোমেলো, গলা ছেড়ে
ডাকছি, অথচ
কোথাও কারুর কোনো কণ্ঠস্বর নেই।যখন মানুষ কোনো স্থির লক্ষ্যে দ্রুত
পৌঁছে যেতে চায়
তখন পথের ধারে দোয়েলের শিস শুনে অথবা দিঘিতে
মাছের রূপালি ঘাই দেখে,
ঝরনা-ধ্বনি শুনে
থমকে দাঁড়ানো, এই মতো কালক্ষয়
সমীচীন নয়। পূর্ণিমার, মল্লিকার প্রেমে পড়া
কস্মিনকালেও নয় লক্ষ্যভেদী পথিকের যোগ্য আচরণ। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রকৃতিমূলক | আজ থেকে দেখব সকালসন্ধ্যা আমি মেঘেদের,
পাখিদের ভেসে-যাওয়া। আবার দেখব ভালো করে
কী করে গাছের পাতা, ভোরের শিশির পাতা থেকে
ঝরে যায়। বাগানের মৃত্তিকার পোকা মাকড়েরা
কী ভাবে খুশিতে ঘোরাঘুরি করে চেনা এলাকায়,
দেখে নেব। বহুকাল জঙ্গলের মাথায় চাঁদের
মুকুট দেখি নি; ঝিলে মুখ ডুবিয়ে চিত্রল কোনো
হরিণের জলপান অদেখা রয়েছে কতকাল।বড় বেশি হৈ চৈ ছিল চতুর্দিকে, ছিল জামা ধরে
টানাটানি আর গলা ফুলিয়ে বাক্যের ফুলঝুরি
তাৎপর্যহীনভাবে ছোটানো, বাজানো, ডুগডুগি
মেলায়; এখন সঙঘ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে
নদীতীরে কিংবা শাল তাল তমালের বনে ঘোরা,
কবর, কোকিল, ঝর্ণা, পাকদণ্ডি দেখা, শুধু দেখা। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কখনো বারান্দা থেকে চমত্কার ডাগর গোলাপ
দেখে, কখনো বা
ছায়ার প্রলেপ দেখে চৈত্রের দুপুরে
কিংবা দারুমূর্তি দেখে সিদ্ধার্থের শেল্ ফ-এর ওপর
মনে করতুম,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড়ো শান্তিপ্রিয় |
যখন আমার ছোট্ট মেয়ে
এই কোণে ব’সে
পুতুলকে সাজায় যতনে, হেসে ওঠে
ভালুকের নাচ দেখে, চালায় মোটর, রেলগাড়ি
ঘরময়, ভাবি,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড়ো শান্তিপ্রিয় |
যখন গৃহিণী সংসারের কাজ সেরে
অন্য সাজে রাত্রিবেলা পাশে এসে এলিয়ে পড়েন,
অতীতকে উসকে দেন কেমন মাধুর্যে
অরব বচনাতীত, ভাবি—–
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন শান্তিপ্রিয় |
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |
অস্ত্রের ঝনঝনা
ধমনীর রক্তের ধারায়
ধরায় নি নেশা কোনোদিন
যদিও ছিলেন পিতা সুদক্ষ শিকারী
নদীর কিনারে আর হাঁসময় বিলে,
মারিনি কখনো পাখি একটিও বাগিয়ে বন্দুক
নৌকোর গলুই থেকে অথবা দাঁড়িয়ে
একগলা জলে | বাস্তবিক
কস্মিনকালেও আমি ছুঁই নি কার্তুজ |গান্ধিবাদী নই, তবু হিংসাকে ডরাই
চিরদিন ; বাধলে লড়াই কোনোখানে
বিষাদে নিমগ্ন হই | আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |
মারী আর মন্বন্তর লোক শ্রুত ঘোড়সওয়ারের
মতোই যুদ্ধের অনুগামী | আবালবৃদ্ধবনিতা
মৃত্যুর কন্দরে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে
অবিরাম | মূল্যবোধ নামক বৃক্ষের
প্রাচীন শিকড় যায় ছিঁড়ে, ধ্বংস
চতুর্দিকে বাজায় দুন্দুভি |
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |বিষম দখলীকৃত এ ছিন্ন শহরে
পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিগ্যেস করুন,
সৈনিক ধর্সিতা তরুণীকে
জিগ্যেস করুন,
কান্নাক্লান্ত সদ্য-
বিধবাকে জিগ্যেস করুন,
যন্ত্রণাজর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে
জিগ্যেস করুন,
বাঙালি শবের স্তূপ দেখে দেখে যিনি
বিড়বিড় করছেন সারাক্ষণ, কখনো হাসিতে
কখনো কান্নায় পড়েছেন ভেঙে—-তাকে
জিগ্যেস করুন,
দগ্ধ, স্তব্ধ পাড়ার নিঃসঙ্গ যে-ছেলেটা
বুলেটের ঝড়ে
জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া
ঘোড়ে ইতস্তত, তাকে জিগ্যেস করুন,
হায়, শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন,
এখন বলবে তারা সমস্বরে যুদ্ধই উদ্ধার | |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | না, কোনো লুকোছাপা নেই, কখনো কখনো
আমার কোনো কোনো অব্যক্ত ভাবনা
দূর শতাব্দীর আফ্রিকার অন্ধকারের মতো
গুমরে ওঠে, যেন বোবার গোঙানি।
বহু নিশুত রাতের মদিরা আমার শিরায় শিরায়
জমতে থাকে; রোমকূপ ফুঁড়ে প্রবাহিত হ’তে চায়
দিন-দুপুরে,
অথচ কোনো বিস্ফোরণ ঘটে না। কে যেন
শরবিদ্ধ প্রাণীর মতো সারাক্ষণ ভাষাহীন
আর্ত স্বর হ’য়ে আহত উন্মত্ততায় ঘুরতে থাকে
আমার আস্তিত্বের পরতে পরতে।প্রায়শ নিশ্চুপ থাকি, মুখে কথা সরে না সহজে;
নিজের এই অক্ষমতাকে সুফীদের আত্মগত নিস্তব্ধতায়
নিমজ্জন
এবং উপনিষদের দ্বিতীয় পাখির অবিরাম,
অকস্পিত দৃষ্টিপাতের
দৃষ্টান্তের আড়ালে ঢাকতে চেষ্টাশীল আমি।
মাঝে-মধ্যে ভাষার প্রয়োজনীয়তা
অবান্তর মনে হয়। মনের ভেতর ডুবসাঁতার কেটে
মনোমীনের সন্ধানহ শেয়।অথচ তুমি কখনো তোমার চোখের চাউনি,
হাতের নড়া,
শরীরের কোনো বিশেষ ভঙ্গি দিয়ে
এই আমাকে কেমন বাঙ্ময় ক’রে তোলো।
আমার এই চোখ, কান, নাক, হাত,
রোমরাজিময় বুক,
প্রায়-মূক মুখ কথা বলতে থাকে
অবিরল কখনো কখনো।
এই তো সেদিন দুপুরবেলা কী-যে বললে তুমি আর
আমার
কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হলো কথায় ঝর্ণাধারা, ‘এই
ভূমণ্ডল, এই সৌরলোক, বিশ্বমানব-
সবকিছুই আমার।‘ তোমাকে প্রথমবার ‘তুমি আমার’
কথাটি বলতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দের কুশাঙ্কুরে
ভীষণ বিদ্ধ হয়েছিলাম
আড়ষ্ট হ’য়ে এসেছিল আমার জিহ্বা;
কিন্তু সেদিন আমি বার বার উচ্চারণ করলাম
‘তুমি আমার,।
তখন আমাকে প্রগল্ভ মনে হ’তে পারতো।তুমি আমাকে দিয়ে বলিয়ে নাও এমন সব কথা,
যা বলবার আগেও আমার মধ্যে ছিল না।
হ্যাঁ, তুমি আমার ভেতর থেকে বের ক’রে আনো
অভাবিত অনেক কিছু। এবং কতবার তুমি
একটি ইঙ্গিতে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছ অনেক
কবিতা।
তুমি কি আমার কাছে ছিঁচকাঁদুনে প্রেমের পদ্য
প্রত্যাশা করো?
এই ধরো, ন্যাকা ন্যাকা যত সব বুলি যা মুহূর্তেই
অপরিণত উঠতি তরুণ তরুণীদের মন ভেজায়,
স্যাঁত স্যাঁত ক’রে তোলে। না, প্রিয়তমা,
আমাকে দিয়ে ওসব কিছু হবার নয়।অব্যশই আমাকে তুমি কথাদের মাঝে নিয়ে যাবে,
তুমি দেখবে আমাকে খুব কাছ থেকে,
আমার হাত নিয়ে খেলা করবে আর
আমার মগজের কোষ থেকে, হৃদয়ের তন্ত্রী থেকে
টপ্ টপ ক’রে ঝরবে শব্দাবলি
কবিতার খাতার সফেদ পাতায়, সেগুলো
আমার নিজের মতো ক’রেই সাজিয়ে নেব
রাতের শেষ প্রহরে কিংবা আকাশের উষ্ঠে যখন
প্রত্যুষের চুম্বন অঙ্কিত হয়। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | দন্ডিত মানুষ আমি, বসে আছি একা অন্ধকারে
গৃহকোণে মুখ ঢেকে। চৌদিকে কবন্ধদল নাচে
উন্মাতাল, কী আমার অপরাধ? কবিতার কাছে
মানুষ হয়েছি বলে সুন্দরের স্তবে বারে বারে
তন্ময় হয়েছি বলে আমি আজ বীভৎস ভাগাড়ে
কাটাবো প্রহর শুধু নরমুন্ডময় শীর্ণ গাছে
দৃষ্টি রেখে সর্বক্ষণ? প্রকৃতির আনাচে-কানাচে
ওড়ে শ্মশানের ছাই, বসে আছি দীপ্ত অহংকারে।স্বেচ্ছায় নিয়েছি দন্ড, কাউকে দিই না তাই দোষ।
যে যা চাইবে আজ সবই দিতে পারি নির্দ্বিধায়
আমার উরুর মাংস তাল তাল কিংবা কর্ণমূল
এবং রাখতে পারি হাত তীব্র মোমের শিখায়।
সর্বদা উপেক্ষা করে ডাকিনীর প্রেতের আক্রোশ
শ্মশানেও কালেভদ্রে ঝরে যায় শেফালি, বকুল। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | এভাবে কতক্ষণ বসে থাকব চোখ দুটোকে প্রতীক্ষা-কাতর
করে? তুমি কি চাও আমার শরীর হয়ে উঠুক বল্মীকময়?
আমার নিজস্ব ধ্যানে কেবল তোমাকেই ধ্রুবতারা মেনে ঠায়
বসে থাকব মাসের পর মাস উপবাসে শীর্ণ? নিদ্রাহীনতায়
রুক্ষ, জীর্ণ? যদি জানতে পারতাম তোমার প্রকৃত ইচ্ছা, আমি
নিজেকে প্রস্তুত করে নিতাম সেই অনুসারে। এখন আমি সারাক্ষণ
গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছি; তোমার মন জুগিয়ে চলার পথ
খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। কখনও প্রজাপতি এসে আমাকে জিগ্যেশ
করে আমি কেন এমন দিশেহারা? কখনও দোয়েল আমার কাঁধে
এসে বসে, উদ্বিগ্ন সুরে জানতে চায় আমার মনের খবর আর কখনও
জানলার পাশের গাছের ডালটি গ্রীবা বাড়িয়ে আমাকে সবুজ
সমবেদনা জানায়। কী বলে ওদের উদ্বেগের ছায়া মুছে দেব, ভেবে
পাই না। ওদের কাছ থেকে কিছু শব্দ সংগ্রহ করে নিজের
নিঃসঙ্গতাকে তোমার পৌনঃপুনিক বিরূপতার কাঁটাগুলোকে
সহনীয় করে তোলার জন্যে কয়েকটি পঙ্ক্তি রচনায় উদ্যোগী হই
আষাঢ়ের এই গোধূলি বেলায়। বাল্মীকি হওয়া আমার সাধ্যাতীত।
আমার হাতে তাঁর বীণা নেই। আমি একতারা বাজিয়ে বাজিয়ে
সময় কাটাই। এই সুরে মুগ্ধ হবে গৌড়জন, এই অসম্ভব দাবি কি
আমাকে সাজে? আমার এই একতারার সুর যদি তোমার শরীরে
শস্য ক্ষেতের ঘ্রাণ বুনে দিতে পারে, যদি তোমার বিরূপতার
অমাবস্যায় আনতে পারে জ্যোৎস্নার ঝলক, ঠোঁটের রুক্ষতায়
ফোটাতে পারে গোলাপ, তবেই এই শূন্য ঘরে আমার বাউল-নাচ।
একবার তুমি তোমার অভিমানের ধূলিঝড় থামিয়ে এই আমাকে
একটিবার এসে দেখে যাও।
(মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | ‘আচ্ছা জনাব, আপনি তো হামেশা
মেঘের মুলুকে থাকেন, তাই না?’‘মাফ করবেন জনাব, প্রায়শ এই অধম
জমিনেই থাকে, কী রোদে, কী বৃষ্টিতে; তবে হ্যাঁ,
সত্যি বলতে কি, কালেভদ্রে মেঘলোকে
কী করে যে চলে যাই, জানি না নিজেই।‘‘মাফ করবেন, আমি ভাই অতসর বুঝি না।
লোকে বলে, তাঁরাও উঁচু কিসিমের মানুষ,
ইয়া মোটা মোটা কেতাব লিখেছেন
গহীন রাতের চেরাগ জ্বেলে বিস্তর। তাঁদের
কথা তো বানের পানিতে ভাসাতে পারি না,
মগজের খাস কামরায় জীইয়ে রাখি।‘‘নয়, নয়, কস্মিনকালেও নয়। তাঁদের
কথামালা ধোঁয়ায় মিলিয়ে দেয়ার
মতো নয়, তাঁরা যা বলেন তা বাজারের
বেজায় কিমতি জিনিশ। আমাদের মানে
আমরা যারা মাঝে মাঝে মেঘে ভাসি, নীলিমায়
সাঁতার কাটি, ফুটফুটে তারা ছুঁয়ে দেখি,
তাঁদের নোস্খা ঠিক হজম হয় না,
হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলি অশ্লীল
বেয়াদবের মতো। আচ্ছা চলি, মাটিতে
বহুদিন পা রেখে চলাফেরা করেছি, বিস্তর
হোঁচটও জুটেছে। এখন খানিক দূরে, মানে
মেঘকন্যার চুমো খেতে যাই, ভাই। গুড বাই।‘ (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | ডাকাবুকো লোকগুলো কেবল নিজেরাই
তেড়ে আসছে তা’ নয়
আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে ডালকুত্তাদেরও
কী হিংস্র আষ্ফালনশিকারী কুকুরগুলোকে রোখার মতো
মন্ত্রপূত মাংসখন্ড আমার হাতে নেই
নক্ষত্রের নীড়ে লতাগুল্মের দূর্ভেদ্য নিবাসে
মাছের রূপালি ডেরায় ঠাঁই পাবো কী ক’রে
ট্রাফিকচর্চিত রাস্তায় জমে-থাকা পানি হুক্কাহুয়া
ফুটপাত প্রগলভ মাইফ্রোফোন হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া
রেডিও টেলিভিশন সংবাদপত্র হুক্কাহুয়া
উঙ্কি-আঁকা সন্ধেবেলায় রেস্তোরাঁ হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়াডালকুত্তাদের তপ্ত নিঃশ্বাস
আমার গ্রীবার পড়শী সারাক্ষণ
স্বপ্নের ভেতরও
ওদের ক্ষমাহীন কর্কশ আঁচড় আমার আত্মায়পিপাসায় বুক খরার জমির মতো চৌচির
তবু ছুটছি
কাঁটায় কাঁকরে পা দুটো ক্ষতবিক্ষত
তবু ছুটছিওরা কারা আসছে উল্টো দিক থেকে
কণ্ঠে বরাভয়ের গান
প্রায় বেরিয়ে-পড়া আমার চোখ
এখন জ্বলজ্বলে বাঁচার তীব্রতায়
আমার চোখে নিসর্গের চুল ওষ্ঠ স্তন নাভিমূল
আর নিতম্ব বেহেশতের বিকল্প (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | (টি , এস এলিয়টকে নিবেদিত)
আমরা ভেবেছিলাম খড়ে-ঠাসা মাথা নিয়ে শুধু
হবে না ঘুরতে আর সাত পুরুষের
বিধ্বস্ত ভিটায় কিংবা জনশূন্য অলিতে গলিতে
প্রলাপের ঝোঁকে
হবে না কুড়াতে বুঝি সময়ের সুতীব্র ধিক্কার।
যাত্রারস্ত হয়েছিলো মনে,
তোমাকে সুদূর কোনো পিতামহ ভেবে
মহানন্দে বাড়াবো পা নতুন যুগের চৌমাথায়।
হা কপাল! তোমারই গণ্ডিতে
এখনও রয়েছি বাঁধা, জানি
চুকানো যায় না ঋণ বুড়ো মোড়লকে
কানাকড়ি দিয়ে।
অস্তিত্বের চতুর্দিকে কখন দেয়াল
হয়ে গেছে গাঁথা,
এখন সেখানে মাথা ঠুকে
কী ভীষণ অর্থহীন অলীক ভাষায়
পরস্পর কথা বলি, ঘেন্নায় দেখি না মুখ কারো।
যখন-তখন ভয় পাই, চমকাই
নিজের বিকৃত ছায়া দেখে
আর মনে হয়
সবকিছু মেরামত সাপেক্ষ এখনো,
তাই ‘মিস্তিরিকে ডাকো’বলে
ভীষণ চেঁচিয়ে উঠি
সামনের সিঁড়ির পাশে
ধ্বংসের রাজধানীতে!
আমাদের চতুর্দিকে রাস্তা খোলা, তবু
কোথাও পারি না যেতে। কে এক চতুর
বাজিকর শস্তা কিছু আলোর খেলায়
সর্বদা মাতিয়ে রাখে, স্ফুর্তি জাগত!বন্ধুর কামিজ কোর্তা অকাতরে নিজের বলেই
হামেশা চালিয়ে দিচ্ছি, আমি খাঁটি নবীন যুবক।শস্তা নভেলের খালে চালাই নিরুদ্ধ কামনার
বেসামাল নৌকোটিকে। আমার ভোটাধিকার নেই
জীবনের নির্বাচন কেন্দ্রে আমি ব্যালট পেপার
হারিয়ে ফেলেছি যেন, পাতিপাতি করে খুঁজি তবু
পাই না হদিস তার। পক্ষান্তরে জীবনকে বলিঃ
কী খেল দেখালে ভায়া, বেধড়ক বসিয়েছো পথে
এবং নিয়েছো কেড়ে ছলে বলে সব পুঁজিপাটা।প্রত্যহ বন্ধুরা বলেঃ “কেন শুধু আগুনের ঝড়ে
বল তো কিসের মোহে রাত্রিদিন পাখা পোড়াচ্ছো হে?
চেয়ে দ্যাখো কয়েকটি যুবা,-বাক্সর্বস্বের দল-
হাঁটু মুড়ে বেপরোয়া দুরাশার মহান চত্বরে
রাত্রিকে করছে পান ক্রমাগত চাঁদের গেলাশে!
তুমি শুধু ভয় পাও, যেন আর্ত হরিণের চোখে
জটিল লতার ছায়া, অথবা বাঘের থাবা কাঁপে।উপদ্রুত কেরানীর বিশুষ্ক মুখের মতো যাচ্ছেতাই এক
অন্ধকারে আমরা স্বপ্নের
গলা টিপে নানাবিধ হত্যাকাণ্ডে মাতি,
কখনো আবার
জীর্ণ হোটেলের
টেবিলে চিবুক রেখে বলি, আমাদের মনীষাকে
বয়স্ক করেছো ভরে আমাদের সংকীর্ণ আকাশ।জনাকীর্ণ পথে হাঁটি, আওড়াই ধ্যানমগ্নতায়ঃ
হতশ্রী জীবনে
কিছুটা পালিশ দাও প্রভু, জানতাম
একদা ফ্লেবস ছিল সুকান্ত পুরুষ, দীর্ঘকায়। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আহ্ কতকাল পর দেখা। এখন তোমার কোনো
খবর রাখি না বন্ধু, এ লজ্জা আমার। কী করে যে
তোমাকে ভুলেছিলাম এতদিন, অথচ দিন ছিল
আমরা দু’জন দিব্য একই বিছানায় ঘুমোতাম
গলাগলি, দাড়ি কামাতাম একই ব্লেডে। পরস্পর বলাবলি
করতাম নিজ নিজ স্বপ্ন কথা। আহ্ কী সুন্দর
স্বপ্নই না দেখতাম আমরা তখন।
সেসব স্মরণ করে বুকের ভেতর হু হু হাওয়া বয়ে যায়।কী-যে হলো, সঙ্গের সংঘর্ষে বাচালের হুমকিতে,
সঙ্গীতের ভ্রষ্টাচারে তুমি দূরে, খুব বেশি দূরে
সরে গেলে; আমাকে গিলতে হলো নোংরা।
বার বার বিসমিষা পাক খায়, ভেদবমি হ’য়েও নিস্তার
নেই, দ্যাখো আজ আমি গুলি-খাওয়া বাঘের মতোই
আপন গুহায় শুয়ে ক্ষত চেটে নিরাময়
চাই আগোচরে, ভুলে যেতে চাই সেই আত্মঘাতী
তমসার সরীসৃপ-স্মৃতি। হা করি, কী নিঃস্ব আমি।যাক গে, ভালোই হ’লো, হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা
এই অবেলায়; হয়তো আমি
নিজেরই অজ্ঞাতসারে তোমাকে খুঁজেছি
অন্তরের বাহিরে সর্বক্ষণ। দ্রষ্টা তুমি, এ গরিব
ভিখিনীকে তোমার ভেতরে টেনে নাও,
হৃদয়ে রঙিন পাখি পোষার অবাধ অধিকার
দাও আর তোমার আশ্চর্য সব স্বপ্ন জাগাও আমার চোখে,
আমিও তোমারই মতো শুদ্ধ হতে চাই। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | খবদ্দার খোকা তুই কোনোদিন শিল্পের মৃগকে
দিবিনে ঘেঁষতে ত্রিসীমায়। বরং ডিঙিয়ে বেড়া
ভাষ্য, টীকা, দর্শনের মহানন্দে নিশ্চিন্দির ডেরা
বাঁধিস মনের মতো। জীবনকে সঁপে দিয়ে ছকে
বাজাবি ঢোলক নিত্য; চাকরির চরম নাটকে
সাজলে বিখুঁত হুঁকোবরদার, সমাজের সেরা
মুরুব্বির তল্পি বয়ে সামলালে নথিপত্র ঘেরা
অস্তিত্বকে, পৌঁছে যাবি উন্নতির প্রশস্ত সড়কে।অক্ষান্তরে শিল্পের আঁতুড়ঘরে আছে কালকূট
হতাশার। রাত্রিদিন বিষাক্ত হাওয়ায় শ্বাস টেনে
কী পাবি অবুঝ তুই? অন্তহীন যন্ত্রণা, বিষাদ
অথবা পতন শুধু। সাফল্যের বিখ্যাত মুকুট
ক’জনের ভাগ্যে জোটে? তার চেয়ে স্থুলচর্ম বেনে,
বীমার দালাল হওয়া ভালো, ভালো ফুর্তির আস্বাদ। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রকৃতিমূলক | এখন আমার যে বয়স সে বয়সে পৌষ, মাঘে
শীতের সুতীক্ষ দাঁত সহজেই ভেদ করে মাংসের দেয়াল
আর কেঁপে ওঠে খুব সত্তার চৌকাঠ। অন্ধকার
ঘরে একা বসে ভাবি, কী উদ্দাম ছিল
একদা আমার যৌবনের ফাল্গুনের পুষ্পময়
দিনগুলি, বৈশাখী ঝড়ের মতো আবেগের ঝাপ্টা
বয়ে শহরের অলিগলি চষে বেড়াবার দিনগুলি আর
কবিতায় মশগুল নিজের সঙ্গেই কথা-বলা রাতগুলি।সেকালের শীতের সুতীক্ষ্ণ দাঁতে হতো না তেমন
শীতল শরীর এই সাম্প্রতিক বুড়ো লোকটার
কিছুতেই; বসন্ত বাহার রাগে নিয়ত উঠত বেজে সবই
নিমেষে তখন। আজ জবুথবু
পড়ে থাকি এক কোণে হৈ-হুল্লা, মিছিল থেকে দূরে। কোনও দিন
নব্য কোনও কবির বইয়ের
পাতায় উৎসুক চোখ পাতি, স্বাদ নিই, কখনও বা দেখি
কাছের গাছের ডালে বসে-থাকা পাখিটিকে-ওর শীত নেই?সত্য, এখন তো এই শরীর শীতল অতিশয়
ঋতুর কামড়ে, কিন্তু হৃদয়ে আমার
ঝরে না তুষার আজও; কী আশ্চর্য, এখনও সেখান
প্রফুল্ল ধ্বনি হয় বসন্তের কোকিলের গান
প্রায় অবিরাম, সেই গানে প্রস্ফুটিত
হতে থাকে কারও কারও নাম। অকস্মাৎ চোখে পড়ে
কে যেন তরঙ্গ তুলে কুয়াশায় হেঁটে যায় একা
এবং পরনে তার অপরূপ মহীন লেবাস। সে রূপসী
তাকায় না পেছনে একটিবারও। তার হাত ধরে
নিবিড় যাচ্ছেন হেঁটে নিভৃত জীবনানন্দ প্রলম্বিত ছন্দে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোকটিকে বাতিগ্রস্ত বলা
ঠিক হবে না, যদিও তিনি
কিছুট উটকো ধরনের মানুষ আর হর-হামেশা
বলেন মাথা-খারাপ করা কিছু কথা।
বরাবরই দেখে আসছি,
আমার প্রতিবেশীর চুল প্রায় সকল সময়
উস্কো খুসকো, অনবরত ঝাড়েন সিগারেটের ছাই,
আর কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে
মটকাতে থাকেন আঙুল। হঠাৎ কোনো কারণে আড্ডায়
তার মেজাজ সাপের ফণার মতো লাফিয়ে উঠলে,
আমি কোনো দ্বিরুক্তি না করে
সারা ময়দান তার হাতেই ছেড়ে দিই। ভদ্রলোক
ভীষণ আসক্ত নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতি। তাই বলতে যতটা
ভালোবাসেন, শুনতে ততটা নয়।অনেকে তাঁকে পছন্দ করে না, কেউ করে বেজার
সন্দেহ। কারো কাছে তিনি সিআইএ-র
এজেন্ট, কেউ তাকে কেজিবি-র দালাল বলে
শনাক্ত করতে আগ্রহী। এ সন্দেহ সন্দেহ খেলা চলে
তাঁর আড়ালে। তিনি টের পান কিনা জানি না। তবে প্রায়শই
‘কী জানেন, সোনার রেকাবিতে আরশোলা
নির্দ্বিধায় হেগে দিতে পারে’ বলে আমার প্রতিবেশী
সিগারেটে তন্ময় সুখটান দেন। এই বাক্যটি তিনি,
বলা যায়, ধুয়ো হিসেবে ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।কোনো কোনোদিন আড্ডায় মাঝখানে
তিনি বেমক্কা বলে বসেন, ‘এ পাড়ায় একটি বাড়িরও
দেয়াল নেই, প্রকৃত কফিন আছে
প্রতিটি উঠোনে।‘ কারুর ভুরু কুঁচকে ওঠে কেউ হাসে
ফিচেল হাসি কেউবা
চেয়ারের হাতলে তবলা বাজাতে শুরু করে, দৃষ্টি
চালান করে জানালার বাইরে।এ ধরনের কথা যে তিনি আসর মাৎ করার জন্যে বলেন,
তা নয়। এইতো সেদিন অফিসের দিকে
রওয়ানা হয়েছি, আমাদের ব্যাকাট্যারা গলির মোড়ে
দেখা হয়ে গেলো আমার সেই প্রতিবেশীর সঙ্গে,
কাছে ধারে কেউ নেই; কুশল জিগ্যেস না করেই
তিনি বললেন, ‘বুঝলেন রাহমান সাহেব, এ শহরের
প্রতিটি যুবতীর শরীরে মাছে আঁশের মতো
কিছু একটা গজাতে শুরু করেছে, আমি
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।‘ তিনি যে মাছের বদলে হিসহিসে
সাপ শব্দটি ব্যবহার করেননি,
সে জন্যে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম।
পরদিন তিনি বললেন,
‘আমার টেবিলটা কাল সারারাত কেঁদেছে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর মাঝে মাঝে গান গেয়েছে
মাথা-বিগড়ে-যাওয়া ওফেলিয়ার মতো।‘বলা নেই, কওয়া নেই, এক বিকেলে
সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে
‘চঞ্চল টাকা আঁচলে বেঁধেনা’ ব্যাংকের এই বিজ্ঞাপনটি
তিনি এভাবে আওড়ালেন, যেন
কোনো ধ্রুববাক্য উচ্চারণ করছেন।তাঁর আরো কিছু বেধড়ক উক্তি-
সেদিন দেখলাম চৌরাস্তায় একজন স্যুটপরা মাকুন্দ
গবাগব গিলছে সংস্কৃতির শালপাতা।
আমাদের এই শহর যদি পুরোদস্তুর একটা বার্থ ডে কেক
হয়ে যায়, তাহলে
নিশ্চয় ডগমগে চৈত পরব শুরু হয়ে যাবে চারদিকে।
আচ্ছা বলুনতো আপনারা কি কেউ
শহীদ মিনারের ওপর এক ঝাঁক ধাতব শকুনকে ওড়াউড়ি
করতে দেখেন না সবসময়?
আমার উঠোনে ক্লিওপেট্রার কালের জাহাজ
নোঙর ফ্যালে; কুরোসাওয়ার সাত সামুরাই
চকচকে তলোয়ারের চমৎকার খেলা দেখার মধ্যরাতে;
প্রমেথিউসের টাইটানিক পায়ে গজিয়ে উঠেছে মস্ত গোদ।আমরা ক’জন মেতেছিলাম ইতিহাসের
গতিপ্রকৃতি নিয়ে। আলোচনা যখন উত্তজনার
চূড়ায় থরো থরো, তখন আমার প্রতিবেশী প্রায় কবিতা
আবৃত্তির ধরনে বললেন,
‘ইতিহাস আঠার মতো আটকে আছে ঝকঝকে
কেতাদুরস্ত কূটনীতিকদের চটপটে পাছায় আর আ’মরি
নিতম্ব উঁচিয়ে-রাখা বিশ্বসুন্দরীদের
প্রতিযোগিতা-লোলুপ চুচিতে।সত্যি বলতে কি, মানব স্বভাবের কোন্ এলাকায়
আমার প্রতিবেশী অবস্থান,
এ ব্যাপারে আজ অব্দি আমি মনস্থিত করতে পারিনি। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এখন রাত আড়াইটা। টেবিলে ঝুঁকে আমি লিখছি। মৃত্যুশয্যাপ্রতিম গলিতে
হঠাৎ কুকুরের হাসি না কান্না, বোঝা দায়। কান খাড়া করে কিছুক্ষণ বাইরের
অন্ধকারে তাকিয়ে থাকি। আবার একটি বাক্যের খণ্ডাংশকে পুরো সাজিয়ে
তুলতে কলম ধরি। কয়েক মিনিট কাগজ আর কলমের মোহন ঘর্ষণ চলে,
এমন সময় আমার মার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি। এক শ’ পাঁচ ডিগ্রির জ্বরতপ্ত
কপালে ন্যস্ত শীতল পানিপট্রির মতো স্নেহার্দ্রে হাত আমার কাঁধে রেখে মা
বললেন, ‘বাচ্চু, তুই এত রাত জেগে লিখছিস? তোর চোখে না ভয়ঙ্কর অসুখ?
আজকাল তোর বাম ফুসফুস তো ঘন ঘন ভোগাচ্ছে তোকে। ফজর হতে
এখনও অনেক দেরি। যা, সূর্য না ওঠা পর্যন্ত ভালো করে ঘুমিয়ে নে। এভাবে
রাজ জেগে লিখলে তুই তো জলদি সব আন্ধার দেখতে শুরু করবি। চোখ
দুটোই খুইয়ে বসবি। বিমারি আরও বেশি খুবলে খাবে তোকে। আয় বাচ্চু,
তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিই যেমন দিতাম তোর সুদূর গোলাপ গাছের সবুজ
কোমল পাতা আর ভোরের কচি, মধুর রোদের মতো ছেলেবেলায়। অনন্তর
মা মিলিয়ে গেল রাতের হাওয়ায়।মার মৃত্যুর পর দেখতে-দেখতে সাত মাস কেটে গেছে। তাঁর চলে যাওয়ার
পর কয়েকদিন গোরস্তানে গিয়েছি, দাঁড়িয়েছি তাঁর কবরের পাশে বিষণ্ন
হৃদয়ে। এর পর বহুদিন যাওয়া হয়নি। এক সময় এমন ছিল যখন একদিন
তাঁর জ্যোতির্ময়ী মুখ না দেখলে ভালো লাগত না আর আজকাল তাঁকে না
দেখে দিব্যি মেতে আছি নানা কাজে। হায়, তাঁর সমাধিও কেমন ধূসর হয়ে
উঠছে আমার স্মৃতির কবরস্তানে। প্রাণের স্পন্দনই মানুষের চির-কাঙ্ক্ষনীয়,
মৃত্যুর শৈত্য তাকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দেয়।লেখার খাতা থেকে চোখ সরিয়ে দেখি, দিগন্তের অন্ধকারকে অধিক
অন্ধকারাচ্ছন্ন করে অ্যাপোকোলিপসের চার ঘোড়সওয়ার ছুটে আসছে। ওদের
ঘোড়ার ক্ষুর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে সর্বব্যাপী সর্বনাশের হল্কা। কবরখানার
সমাধিগুলো ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে অগণিত মুর্দা জীবিতদের ঘরবাড়ি
জবরদখল করবার জন্যে। হে স্নেহময়ী মা আমার, এ কী দেখাচ্ছ তুমি
আমাকে! প্রতারক স্মৃতি-স্বপ্ন নিয়ে আর কতকাল থাকতে হবে আমাকে?আম্মা, হে আমার জন্মদাত্রী, সাত মাস পর তোমাকেই আমি যন্ত্রণাকাতর
স্মৃতিগর্ভ থেকে জন্ম দিয়েছি আজ রাত আড়াইটায়। আর কতবার তোমার
জন্মদাতা হব বাস্তবের কাঁকর আর ধুলোবালিতে দাঁড়িয়ে, কে জানে? মা,
আমার এই পঙ্ক্তিমালায় তুমি কি কোনও এতিমের ফোঁপানি শুনতে পাচ্ছ? (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | না, আমি বিলাপ করবো না তার জন্যে, যে আমার
নিজের একান্ত অংশ, স্বপ্ন, ভবিশ্যত; যাকে আমি
দেখেছি উঠোনে হাঁটি-হাঁটি পা-পা হেঁটে যেতে
আনন্দের মতো বহুবার। যখন প্রথম তার
মুখে ফুটেছিলো বুলি, কি যে আনন্দিত
হয়েছি সেদিন আমি; যখন জননী তার ওকে
বুকে নিয়ে চাঁদের কপালে চাঁদ আয় টিপ দিয়ে
যা ব’লে পাড়াতো ঘুম, আমি
স্বর্গসুখ পেয়েছি তখন।
কতদিন ওকে
নিজেই দিয়েছি গ’ড়ে পুতুল এবং
বসেছে সে আমার আপনকার পিঠে, ক্ষুদে অশ্বারোহী।
আমার স্নেহের ঘরে সে উঠেছে বেড়ে
ক্রমান্বয়ে,
আজ সে শুধুই স্মৃতি, বেদনার মতো বয়ে যায়
আমার শিরায়।
কোন কোনদিন স্থাপত্যের গূঢ় সুত্র-বিষয়ক চিন্তার সময়
অকস্মাৎ দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে আমার শয্যার পাশে
সুকান্ত তরুণ;
ইকারুস ইকারুস ব’লে ডাকলেই উজ্জ্বীবিত
দেবে সাড়া। কখনো বা মনে হয় আমার নিজের
হাতে গড়া ডানা নিয়ে দেবে সে উড়াল
দূর নীলিমায়
অসম্ভব উঁচুতে আবার।না, আমি বিলাপ করবো না তার জন্যে, স্মৃতি যার
মোমের মতন গলে আমার সত্তায়, চেতনায়।
সর্বদা সতর্ক আমি, বিপদের গন্ধ সিদ্ধ, তাই
বুঝিয়েছিলাম তাকে সাবধানী হ’তে,
যেন সে না যায় উড়ে পেরিয়ে বিপদসীমা কখনো আকাশে।
কিন্তু সে তরুণ, চটপটে, ঝকঝকে, ব্যগ্র অস্থির, উজ্জ্বল,
যখন মেললো পাখা আমার শিল্পের ভরসায়,
গেলো উড়ে ঊর্ধে, আরো ঊর্ধে, বহুদূরে,
সূর্যের অনেক কাছে প্রকৃত শিল্পীর মতো সব
বাধা, সতর্কতা
নিমেষে পেছনে ফেলে, আমি
শংকিত অথচ মুগ্ধ রইলাম চেয়ে
তার দিকে, দেখলাম তাকে
পরিণাম বিষয়ে কেমন
উদাসীন, ক্রর রোদ্রঝলসিত, সাহসী, স্বাধীন।না আমি বিলাপ করবো না তার জন্যে, স্মৃতি যার
মোমের মতন গলে আমার সত্তায়, চেতনায়।যেন আমি এখন উঠেছি জেগে অন্তহীন নির্জন সমুদ্রতীরে একা
আদিম বিস্ময় নিয়ে চোখে। আস্তে আস্তে মনে পড়ে
নানা কথা, মনে পড়ে বাসগৃহ, বহুদূরে ফেলে-আসা কত
স্থাপত্যের কথা আর নারীর প্রণয়। মনে পড়ে,
আমার সন্তান যেতো পাখির বাসার খোঁজে, কখনো কখনো
দেখতো উৎসুক চেয়ে আমার নিজের
বাটালি ছেনির চঞ্চলতা। মনে পড়ে
দেবতার মতো স্তব্ধ আলোচ্ছ্বাস, তরুণের ওড়া
ভয়ংকর অপরূপ দীপ্তিময়তায়। তার পতন নিশ্চিত
বলেই হয়তো আমি তাকে আরো বেশি ভালোবেসেছি তখন।
পিতা আমি, তাই সন্তানের আসন্ন বিলয় জেনে
শোকবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ পাখির মতন দিশাহারা;
শিল্পী আমি, তাই তরুণের সাহসের ভষ্ম আজ
মৃত্যুঞ্জয় নান্দনিক সঞ্চয় আমার। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কাঁধে মধ্যরাত্রিকে ঝুলিয়ে,
ফুসফুসে নিয়ে
অতিক্রান্ত পথের ধূসর দীর্ঘশ্বাস
বাড়ি ফিরি একা। সিঁড়ি ভেঙে
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে
বন্ধ ঘরে ঢুকে দেখি-আমার চেয়ারে
অচেনা কে একজন ব’সে আছে, উশ্কো-খুশ্কো গালে
ক’দিনের না-কামানো দাড়ি,
দু’ভুরুর মধ্যখানে অমাবস্যা নিথর, গহন।
কী নাম? প্রশ্নের পিঠে আগন্তুক শূন্য ঠোঁট থেকে
‘ব্যর্থতা’ শব্দটি
কেমন গড়িয়ে দিয়ে আমার সম্মুখে তুলে ধরেএক সিট হলুদ কাগজ,
গাঢ় কালো কালিতে কী যেন লেখা, দ’লে-
মুচড়ে সে কাগজ ছুঁড়ে দিই বাজে কাগজের
ঝুড়িতে না প’ড়ে। অকস্মাৎ রূপান্তরে
আগন্তুক একটানা শব্দহীন, খরা-ঝলসিত ঠাঠা হাসি। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | করোনি কসুর দিতে রক্তাক্ত গঞ্জনা খামোকাই
নিত্যদিন; এ শহরে বসবাস হয়েছে কঠিন
আজকাল, গায়ে এসে পড়ে কত বেহুদা কমিন
ক্রমাগত; যেদিকেই যাই ইট পাটকেল খাই
অহর্নিশ, তুমিও বলোনি ছেড়ে কথা বেরহম।
তোমার রসনা থেকে বয়ে যায় শহদের ধারা,
এরকম ধারণার রঙধনু ছিলো চমৎকারা;
ভাবতে অবাক লাগে, এতটুকু পাওনি শরম।সম্প্রতি কী এক আলো সিনায় বেড়ায় নেচে, ফলে
লানতের ভাষা আর অঙ্গারের মতো ধ্বক ধ্বক
করে না আমার ঠোঁটে। খ্যাপা, পোড়া আত্মা ধুয়ে জলে
ধারণ করেছি মুদ্রা ক্ষমার; কুঠার আহাম্মক,
এরকম আচরণে তূণ শূন্য ক’রে দুলদুল
বানালে আমাকে, তবু শ্রীচরণে রেখে যাই ফুল। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | তুমি কি এসেছ ফিরে? তুমিতো জানোই বহুদিন
ধরে আমি নীরেট বধির আর দু’চোখ আমার
জ্যোতিহীন। প্রত্যহ কে এক পাখির সুরের আড়ালে
বলে যায়, ধৈর্য ধরো, প্রতীক্ষা শিখতে হয় তাকে,
যে চায় প্রকৃত রূপ দেখে নিতে অন্তরের চোখে।
বৃশ্চিক দংশন করলে নড়বে না, বেনো জলে
বেবাক তৈজসপত্র ভেসে গেলে শান্ত থাকা চাই।
সবুরে জ্বলবে বাতি ছন্নছাড়া অন্ধকার ঘরে’।
কত আর ধৈর্য ধরি? পক্ষী-পর্যবেক্ষকের মতো
চেয়ে থাকি সর্বক্ষণ দৃষ্টিহীন। প্রতীক্ষার শেষে
আসবে তারার মতো শব্দস্রোত ভেবে কী নিশ্চুপ
বসে আছি; অজস্র বল্মীক এসে আমাকে নিশ্চিত
দেবে ঢেকে। যত শীঘ্র পারো ফিরে এসো এ নিবাসে,
আমার চোখের জ্যোতি আবার স্থাপন করো আজ। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কখন যে আমাকে ভীষণ এক পশু এ পাড়ায়
তাড়িয়ে এনেছে, টের পাইনি। তা’হলে এতক্ষণ
দুঃস্বপ্ন দেখেছি ঘুমে? মনে
হলো সারা শরীরে রয়েছে
গাঁথা সারি সারি কাঁটা। কেন
এই শাস্তি ভোগ করে চলেছি, বুঝি না কিছুতেই।কখনও কখনও ক্ষণকাল অপরূপ গাছঘেরা
হ্রদের কিনারে দেখি নিজেকে শায়িত। কানে আসে
পাখিদের সুরেলা আওয়াজ। অপক্ষণে মনে হয়, কারা যেন
চুপিসারে চলে গেলো অজানায়। আমি ঘাসময়
মাটি থেকে উঠে আস্তে গা ঝেড়ে এগোই
অন্যদিকে ভিন্ন দৃশ্য দেখার আশায়। আসমানে জাগে চাঁদ।ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে চলে যাই, ঠিক বুঝে
ওঠা ঢের মুশকিল। কানামাছি খেলার ধরনে
প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছে স্বস্তি বোধ করা হয় না সহজ আর।
ঝরিয়ে প্রচুর ঘাম ডানে বামে শেষে
বস্তুত নিজের নির্বুদ্ধিতা ভীষণ অসহ্য লাগে। ঘরে ফিরে
ক্লান্তির অসহ্য চাপ দু’ চোখে ঘুমের ছায়া মাখে।সকালে যখন ঘুম ভাঙে সমস্ত শরীরে যেন কেউ শত
তীক্ষ্ণ সুচ বিঁধিয়েছে শাস্তিরূপে। আখেরে ক্লান্তির
কালিমা নিমেষে ঝেড়ে ফেলে
যেন জাদুবলে দিব্যি আলাদা মানুষ হয়ে ফের
কাছের টেবিলে ঝুঁকে অসমাপ্ত এক
কবিতাকে পূর্ণতা দেয়ার বাসনায় উদ্দীপিত হয়ে উঠি। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | যদি আরো কিছুকাল পৃথিবীর ধুলোবালি, জল
আমার সত্তায় লাগে, বাতাস রূপালি
চুলগুলি নিয়ে খেলা করে নিরিবিলি
আরো কিছুকাল, তবে এমন কী ক্ষতি হবে কার?এইতো দেখছি ফুল তার যৌবনের আভা নিয়ে
ফুটে আছে, ডালে বসে পাখি চমৎকার
শিস দিয়ে বিকালকে বেশি বৈকালিক
ক’রে তোলে, বুঝি বা ঈষৎ ঈশ্বরিত!মোড়ায় আছে বসে মা আমার বৈধব্যের শুভ্র
স্তব্ধতায়, স্মৃতিগুলি যেন মেঘমালা থেকে নামে
এবং সাঁতার কাটে তাঁর পায়ের কিনারে। এই
দেখা আরো কিছুকাল থাকুক না হয়।সারা রাত অন্ধকারে বৃষ্টি পড়ে ঘুমের ওপর,
সারা রাত বৃষ্টি পড়ে স্বপ্নের ভেতর,
মায়াবি ঘুঙুর বাজে চরাচরে, শুনে ফেলি অপার বিস্ময়ে-
নামুক এমন বর্ষা বার বার হৃদয়ে আমার। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে স্মৃতি মুড়ি দিয়ে শুই
পাশ ফিরে, দেয়ালে নজর, যেন সেখানে স্বপ্নের
কিছু টুকরো লেগে আছে। কারো হাতে ঘড়ি দোল খায়,
জানালা-পেরুনো হাওয়া মেশেনিদ্রাছুট শরীরে আমার, বোধাতীত
বোধ তৈরি করে ভিন্ন পরিবেশ, অদূরে দাঁড়ানো
কেউ, হাতে ফলময় স্বর্ণথালা দূর তাহিতির,
আমি তাকে শনাক্ত করায় উদাসীন, বেড়ালের ছায়া দেখি।উপর কাঠামো ভেঙে পড়ে; আমার নজর থেকে
যেন এই গাছপালা, তীরে-বাঁধা নৌকো, আলোজ্বলা
ফ্ল্যাটবাড়ি, বন্ধনমালার ধোঁয়া, প্রিয় মুখগুলি
আর বইপত্র লুপ্ত না হয় কখনো (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |