Datasets:
label
stringclasses 6
values | text
stringlengths 1.57k
117k
| is_valid
bool 1
class |
---|---|---|
fe | সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও মানবিক প্রতিরোধ সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও মানবিক প্রতিরোধফকির ইলিয়াস=======================================আমি যে দেশটিতে থাকি এখানে বহুজাতিক, বহুভাষিক মানুষের বাস। অনেক ধর্মাবলম্বী, মতাবলম্বী মানুষ। কারো সঙ্গে কারো কোনো মিল নেই। এরা চাইলে কিন্তু খুব সামান্য বিষয় নিয়েই প্রতিদিন দাঙ্গা করতে পারতো। না- তেমনটি এখানে হচ্ছে না। হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক- আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি।এটি এমন একটি দেশ, মানুষ মানুষের বুকের পাঁজর চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো! যদি এ দেশে কঠোর আইন না থাকতো। না- তারা তা পারছে না। পারবে না। পারবে না এ জন্য, এমন কিছু করলে তাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তাই এ জীবনবাজি রেখে ‘রায়ট’ করবে কে?পাক-ভারত উপমহাদেশ জন্ম নিয়েছে কিংবা বিভক্ত হয়েছে ‘রায়ট’-এর মধ্য দিয়ে। কী ঘটেছিল- তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। এ জন্মইতিহাস নিয়েই জন্মেছে পাকিস্তান-ভারত, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ। একটি ভূখণ্ডে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’, ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ করা হয়েছে। মানুষে মানুষে ধর্মের বিভাজন করা হয়েছে সেভাবেই খুব পরিকল্পিতভাবে।১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় অসংখ্য হিন্দু তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কারণ জিন্নাহ’র দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি নতুন দেশে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষা করা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। এর পরে প্রথমে ১৯৫০ এবং তার পর ১৯৬৪ সালে পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে আবার বহু হিন্দুকে নিরাপত্তার জন্য ভারতে পালিয়ে যেতে হয়। ১৯৭১ সালে হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে, এ বিশ্বাসে দখলদার পাক সেনা এবং তাদের সহযোগীরা প্রবল প্রতিশোধস্পৃহায় খুঁজে খুঁজে হিন্দু-নিধন চালিয়েছিল। বহু হিন্দু বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবী, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে থাকা সহস্রাধিক হিন্দু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল সে সময়ে।১৯৭১ সালের ১ নভেম্বর তারিখে ইউএস সিনেট কমিটিকে দেওয়া একটি প্রামাণ্য প্রতিবেদনে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি লিখেছিলেন, “সব থেকে বেশি আঘাত এসেছে হিন্দুদের উপর, যে সম্প্রদায়ের মানুষদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, দোকান লুট হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিছু জায়গায় তাদের শরীরে হলুদ রঙ দিয়ে ‘এইচ’ লিখে দেওয়া হয়েছে... আর এ সবই হয়েছে ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের আদেশ এবং অনুমতিক্রমে।”এরপরের বাংলাদেশের চিত্র কী বলে? ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। সেই সময় ধর্ষণসহ নানা পাশবিক অত্যাচার করে হিন্দু পরিবারগুলিকে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, এ রকম অনেক উদাহরণ আছে।একইভাবে ১৯৯০ সালে এরশাদের সামরিক সরকারের পতনের পর হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে জামায়াত কর্মীরা তাদের দেশ ছাড়তে অথবা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। সেই সঙ্গে আগুন লাগিয়ে এবং ভাঙচুর চালিয়ে ধ্বংস করা হয় তাদের বাড়িঘর, ব্যবসার জায়গা এবং উপাসনাস্থল। এ সময়ে হিন্দুদের জমি ও অন্যান্য সম্পত্তিও লুট করা হয়েছিল।এ ধারাবাহিকতা চলেছেই। একটি উদাহরণ দিতে পারি। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর হিন্দু-বিরোধী হিংসাত্মক কাণ্ডকারখানার তদন্তে নেমে বিচারপতি এম সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগীয় কমিশন এ ধরনের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য কিছু সুপারিশ করেছিল। সেই সুপারিশে যে সব দুষ্কৃতকারী ২০০১ সালের অক্টোবর এবং ২০০২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৫৫ জনকে হত্যা করা ছাড়াও ৩২৭০টি নির্দিষ্ট অপরাধ করেছিল, তাদের ধরার জন্য দেশের প্রতি জেলায় একটি করে তদন্ত কমিটি অথবা কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। জেলাগুলিতে তদন্তকারী কমিটিগুলির কাজকর্মের উপর নজরদারি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে আলাদা সেল খোলা এবং যাঁরা হিংসার শিকার হয়েছেন, তাঁদের আইনি সহায়তা দেওয়ার কথাও এতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এ সুপারিশগুলি মানা হয়নি। এ ধরনের হিংসাত্মক ঘটনায় জড়িত ২২০০০ জনের নাম করে কমিশন প্রায় সমস্ত অপরাধীকে চিহ্নিত করলেও রহস্যজনকভাবে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে।অথচ এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশে সেই ধারাবাহিকতায় কিছু আক্রমণ করা হয়েছে। নাসিরনগর, হবিগঞ্জ, ছাতক এমন অনেক স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতি ছিল বলে অভিযোগ ওঠেছে। নাসিরনগরের ইউএনও মোয়াজ্জেম ও ওসি আবদুল কাদেরের উপস্থিতিতে একটি সমাবেশে ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্যের পর ওই হামলা হয়।নাসিরনগরের দত্তবাড়ির বাসিন্দা নীলিমা দত্ত বিবিসিকে বলেছেন, ‘এক মুসলমান হামলা করেছে, আরেক মুসলমান বাঁচাইছে। ওরা যদি আমাদের রক্ষা না করতো, তাহলে এখানে লুটপাট হইতো’। তিনি বলছিলেন যে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ তিনি তার জীবনে কখনো দেখেননি। হামলাকারীরা পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করলেও মুসলমান যুবকদের বাধার কারণে বাসস্থানের ঘরে ঢুকতে পারেনি। তবে বাইরে থেকে ঢিল ছুঁড়েছে। এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দত্তবাড়িতে এ ধরনের আক্রমণ হয়নি বলে নীলিমা দত্ত উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও মুসলমানদের সহযোগিতায় হিন্দুরা দত্তবাড়িতে পূজার আয়োজন করেছিল বলে এখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন।নীলিমা দত্ত বলেছেন, যে হিন্দু যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কাবাঘরকে অবমাননা করে ছবি দেওয়া হয়েছিল, তার কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। কে এর নেপথ্যে ছিল তা দেখা দরকার। কিন্তু সে ছবির জের ধরে সব হিন্দুবাড়ি এবং মন্দিরে কেন হামলা চালানো হলো, সে প্রশ্নের উত্তরটাই খুঁজে পাচ্ছেন না নীলিমা দত্ত।বাংলাদেশে এখন যা শুরু হয়েছে- এর নেপথ্য মতলব কী তা খুঁজে বের করা দরকার। কেউ কি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ সব করছে? কেউ কি মুছে দিতে চাইছে সরকারের সকল ভালো কাজের তালিকা?এখন সময় এসেছে মানবিক বিবেক জাগ্রত করার। এই প্রত্যয়েই কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা বাংলাদেশের পবিত্র সাংবিধানিক দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেছেন সেক্টরস কমান্ডারস ফোরামের নেতারা। ফোরাম নেতারা বলেছেন, আমরা কোনো ধর্মের জন্য যুদ্ধ করিনি। আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমরা মনে করি যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায় এ হামলায় তাদের ইন্ধন রয়েছে। এর আগে রামু এবং উখিয়াতেও একই ঘটনা ঘটেছে। এখানে যে সহিংসতা হয়েছে তা সুপরিকল্পিত। দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে একটি চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) কেএম শফিউল্লাহ, মহাসচিব হারুন হাবীব ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ বক্তব্য রাখেন।একই কথা বলেছেন দেশের তথ্যমন্ত্রীও। তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বাংলাদেশে শান্তি বিনষ্টের চক্রান্ত এখনো অব্যাহত আছে। ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও মন্দির ভাঙচুর বাংলাদেশের শান্তি বিনষ্টের চক্রান্তের একটি অংশ। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা যেমন রেহাই পায়নি তেমনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকারীরা রেহাই পাবে না।ইনু বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত আছে সেহেতু বিএনপি ও জামায়াতের ওপর সর্তক দৃষ্টি রাখা উচিত। প্রশাসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থা গ্রহণ করেছে। এটাই সরকারের সিদ্ধান্ত। এর বাইরে বিচ্ছিন্ন মন্তব্যকারীদের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।আমরা একটি কথা প্রায়ই শুনি- ‘দেশ আপনাকে কী দিলো, তা বড় কথা নয়। আপনি দেশকে কী দিলেন- সেটাই বড় কথা’।কথাটি মেনে নিলাম। আচ্ছা, যারা দেশকে সামান্য কিছু না দিয়েই লুটেরা সেজেছে, যারা মুনাফাখোর, চোরাকারবারি, প্রতারক, দখলদার কিংবা রাজনীতিবিদদের পালিত দালাল- এদেরকে ক্ষমতাবানরা এ বাণী শোনাতে পারেন না?আর যারা দেশকে দিতে দিতেই না খেয়ে মরে গেলো তাদেরকে কি দেশের কিছুই দেওয়ার ছিল না? বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ঐক্যকেও মশকরা করা হয়। তারা যাবে কোথায়? যারা দখলদার ওদের সঙ্গে তারা ঐক্য করবে?মানুষ এগোচ্ছে। তাই ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা রাজনীতি করে কিংবা করছে- এদের কাছ থেকে প্রজন্মকে দূরে সরে থাকতে হবে। ভোট আর ধর্ম এক না। ধর্ম একটি পবিত্র আমানত আর রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার দালিলিক বিষয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে কখনোই রাজনীতি চলতে পারে না। রাজনীতির মধ্যে যারা ধর্মকে টেনে আনে তারা ধর্মকে অপমান করে। ধর্ম ধর্মের জায়গায় থাকবে আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকা উচিত।সকল অপশক্তি রোখার প্রধান হাতিয়ার হলো মানুষের ঐক্য। এবং তা হতে হবে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে। তা ছাড়া একটি দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশে একটি কালোশক্তি সবসময় সোচ্চার আছে- থাকবে। এদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ন্যায্যতা-সত্যের পক্ষে।এ জন্য তরুণদের ভূমিকা হতে হবে প্রখর ও সাহসী।-----------------------------------------------------------------------দৈনিক খোলাকাগজ ॥ ঢাকা ॥ ১১ নভেম্বর ২০১৬ শুক্রবার সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:০৬ | false |
ij | আজ মাও সেতুং-এর জন্মদিন। মাও সে তুং। বারবার ইতিহাসের চাকা বদলে দিয়েছেন চৈনিক এই মানুষটি। মার্কসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের বদলে কৃষককে চিহ্নিত করেছেন বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে, গড়ে তুলেছেন সশস্ত্র রেড আর্মি, প্রচলন করেছেন আরণ্যক গেরিলা যুদ্ধের। সত্য এই- বিশ্বময় তরুণেরা আজও হাঁটছে তাঁর দেখানো পথে। আজও নেপাল থেকে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী তরুণেরা পার্বত্য আরণ্যক এলাকায় নিঘূর্ম রাত কাটাচ্ছে চেয়ারম্যান মাও-এর নির্দেশে। চিনে হুনান নামে একটি প্রদেশ রয়েছে। সেই হুনান প্রদেশেই রয়েছে শাওশান গ্রাম। ১৮৯৩। ২৬ ডিসেম্বর। মাও সে তুং-এর জন্ম সেই শাওশান গ্রামেই। পরিবারও ছিল স্বচ্ছল। ভালো স্কুলে পড়েছেন। বাবা ছিলেন কনফুসিয়াসপন্থি। মা ছিলেন একনিষ্ট বৌদ্ধ। কাজেই ছেলেবেলায় এ দুটি মতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। হুনান প্রদেশের রাজধানীর নাম চাঙশা। ১৯১১। মাও চাঙশা-য় চলে এলেন পড়তে। ভর্তি হলেন হুনান টির্চাস কলেজে । এখানেই প্রথম পাশ্চাত্য দর্শন সম্বন্ধে জানতে পারেন। তা হলে বুদ্ধ ও কনফুসিয়াস সব কথা বলে যাননি? যাক। সে সময়টায় চিনে চলছিল কিঙ রাজতন্ত্রের দুঃশাসন। তার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের তীব্র গনআন্দোলন হচ্ছিল। সান ইয়াত সেন ছিলেন জাতীয়তাবাদীদের নেতা। তিনি রাজতন্ত্র ভেঙ্গে গঠন করতে চান প্রজাতন্ত্র। তার ডাকে মাও উদ্ধুদ্ধ হলেন। যোগ দিলেন প্রজাতন্ত্রের সৈন্যবিভাগে । রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে সান ইয়াত সেন জয়ী হলেন। জয়ী হয়ে কউমিঙটাঙ (জাতীয়তাবাদী) দল গঠন করলেন। করে দলের প্রধান হলেন সান ইয়াত সেন। ১৯১৮। হুনান টির্চাস কলেজে থেকে পাস করে চাকরির খোঁজে বেজিং পৌঁছলেন মাও। কাজ জুটল। বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। অখন্ড অবসর। পাঠ করতে লাগলেন সভ্যতার বিস্ময়কর এক তত্ত্ব: মাকর্সবাদ। বুঝলেন মায়ের বুদ্ধবাদ ও বাবার কনফুসিয়বাদ কাজের জিনিষ না। এসব ব্যাক্তিদর্শন চিনের সামাজিক সমস্যা সমাধানে অক্ষম। এবং এসব বালখিল্য দর্শন চিনকে পিছিয়ে রেখেছে। চিনের প্রয়োজন প্রবল আধুনিকায়ন, তথা পাশ্চাত্যকরণ। ১৯১৯। তখন চিনকে আধুনিকায়ন করার লক্ষে চিনের বুদ্ধিজীবিদের তরফ থেকে একটি আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনে মাও যোগ দিলেন। তবে লিখে। সে লেখায় তীব্র সমালোচনা করলেন কনফুসিয়াসের। সেই সঙ্গে ঐতিহ্যবিরোধী আরও সব অনলবর্ষী লেখা লিখলেন মাও। ১৯২০। চাঙশায় ফিরে এলেন মাও। হুনান প্রদেশে গনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য উদ্যোগী হলেন । ব্যর্থ হলেন। ১৯২১। সাঙহাই এলেন। সে সময় চিনের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হচ্ছিল ওখানে। সেই গোপন মিটিং-এ উপস্থিত হলেন মাও। তারপর হুনান ফিরে এসে হুনানে কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক শাখা খুললেন। কী ভাবে ধর্মঘট করতে হয়- শ্রমিকদের তাই শেখালেন। ঠিক ঐ সময়টায় যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলো উত্তর চিন দখলে রেখেছিল। জাতীয়তাবাদী কউমিঙটাঙ দলের প্রধান সান ইয়াত সেন তাদের দমনে সচেষ্ট হলেন। ১৯২৩ সালে কমিউনিষ্টরা জাতীয়তাবাদী কউমিঙটাঙ দলের সঙ্গে গঠন করে জোট। মাও কউমিঙটাঙএ যোগ দিলেন। হলেন সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য। ১৯২৫। জন্মগ্রাম শাওশানে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন মাও। ১৯২৭। কৃষক আন্দোলন নিয়ে লিখলেন। ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিলেন। কেননা মাও লিখলেন যে, বিপ্লবে কৃষকরাই মূল চালিকা শক্তি, শ্রমিকরা নয়। মার্কসবাদবিরোধী বক্তব্য। কাজেই নিজের দলে হইচই পড়ে গেল। ১৯২৭ সালে জাতীয়তাবাদী কউমিঙটাঙ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কউমিঙটাঙ দলের নেতা তখন চিয়াং কাই সেক। তিনি কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ায় প্রবল কমিউনিষ্টবিরোধী দমননীতি অনুসরন করলেন। সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়ে আরেকবার ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিলেন মাও। হুনান প্রদেশের কৃষকদের নিয়ে সৈন্যবাহিনী গঠন করলেন মাও। অবশ্য পরাজিত হলেন। দক্ষিণে পার্বত্য এলাকায় সরে এলেন। জায়গাটার নাম জিয়াংজি প্রদেশ। এখানে তিনি গ্রামীন ভূমি সংস্কারে উদ্যোগী হলেন। ওদিকে অসংখ্য তরুণরা দলে দলে মাও নিয়ন্ত্রিত কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দিচ্ছিল। মাও তাদের সংগঠিত করেন। ইতিহাসে এই সশস্ত্র দলটি রেড আর্মি। এদের লক্ষ একটাই-কৃষকের মুক্তি। আর সে লক্ষ অর্জনে অভিনব গেরিলা যুদ্ধের পথ অনুসরণ করে আরেকবার ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিলেন মাও। ১৯৩৪। চিয়াং কাই সেক জিয়াংজি প্রদেশ ঘিরে ফেলল। (বাংলাদেশে মাওবাদীরা "আর এ বি" দ্বারা নিহত হলেও) এক বিস্ময়কর ও অপ্রতিরোধ্য গতিবেগে সে বেড়াজাল ছিন্ন করে রেড আর্মিকে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন মাও। অতপর? অতপর আরেকবার ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিলেন কৃষকের বন্ধু। কী করলেন তিনি। তিনি আরম্ভ করলেন এক দীর্ঘ পদযাত্রা। যা ইতিহাসে লং মার্চ হিসেবে পরিচিত। রেড আর্মির সঙ্গে ৬ হাজার মাইল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। গন্তব্য? উত্তরের ইয়ানান প্রদেশ। হাঁটতে হাঁটতে অগনন কৃষকের সমর্থন পেলেন মাও; পেলেন অগনন কৃষানীর ভালোবাসা । হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্যে পৌঁছে গেলেন মাও । ক্রমশ বদলে দিলেন চিনের হাজার বছরের পুরনো রুগ্ন কৃষিকাঠামো। অপরকেও বদলে দিতে উদ্বুদ্ধ করলেন। যে কারণে আজও নেপাল থেকে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী তরুণেরা পার্বত্য এলাকায় কাটাচ্ছে নিঘূর্ম রাত ...এমন কী বাংলাদেশেও। মনে থাকার কথা। কউমিঙটাঙ দলের নেতা তখন চিয়াং কাই সেক। তিনি কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ায় প্রবল কমিউনিষ্টবিরোধী দমননীতি অনুসরন করলেন। চিয়াং কাই সেক এর ভূমিকা নিয়েছে চার দলীয় জোট সরকার (এরা জোদদার শ্রেণির হওয়ায়)। মাওবাদী দমনে তারা গঠন করেছে কালো পোষাকের "আর এ বি।" যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এখন দেখা যাক কারা জেতে! ২ বাংলাদেশেও রয়েছে দূর্বল কৃষিকাঠামো। এর দূর্বলতা কাটাতো প্রয়োজন আমূল ভূমিসংস্কারের। গ্রামীন কৃষি-অর্থনীতির আমূল পরিবর্তের সাহস কেউই করে না যেহেতু কেউই বিপ্লবী নয়। এ দেশে ভূমিসংস্কারের কথা কেউ তোলে না। আমরা কি রুঢ় বাস্তবতা এড়িয়ে চলেছি? কেন? অথচ আমরা একটি উন্নত রাষ্ট্রের অধিকারী হতে চাই। তাই যদি হয়-তা হলে আমাদের পড়ে দেখতে হবে মাও সে তুং কী লিখে গেছেন। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অন্তরায়। এদেশের রাজনীতি শহরভিত্তিক। তার নানা চকচকে জৌলুষ। পাকিস্থান আমল থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি ধনী জোদদার পরিবার নিয়ন্ত্রিত। কাজেই বাংলাদেশে কৃষির মূল সমস্যা এড়িয়ে সমস্যা নিরসনে আজও দেওয়া হচ্ছে টোটকা অষুধ। ৩ একদিন হয়তো চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে দেখব কাস্তেহাতুড়ি নিয়ে শহরের উপান্তে পৌঁছে গেছে চেয়ারম্যান মাওয়ে বিশ্বাসী কৃষকেরা। হয়তো, হাসিনা সরকার ব্যর্থ হওয়ার পর। কাজেই-মানে, ঐ ভূমি সংস্কারের বিষয়টি ... তথ্যসূত্র: Rogaski, Ruth. "Mao Zedong." Microsoft® Student 2008 [DVD]. Redmond, WA: Microsoft Corporation, 2007. Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved. সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:১৪ | false |
mk | গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ৬১ টি, যেকোনো ১ টি প্রমাণিত হলেই ফাঁসি !!! গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫ ধরনের ঘটনায় ৬১টি অভিযোগ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫ ধরনের ঘটনায় ৬১টি অভিযোগ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।৬১ অভিযোগ তার বিরুদ্ধে, পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা ও তাদের সঙ্গে চক্রান্তের দায়ে ৬টি, পরিকল্পনার দায়ে ৩টি, উস্কানির দায়ে ২৮টি, সম্পৃক্ততার দায়ে ২৪টি এবং ব্যক্তিগতভাবে হত্যা ও নির্যাতনের দায়ে ১টিসহ মোট ৬২টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে একটি অভিযোগ বাদ দেন ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরের ২১ নভেম্বর গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের ৩৮ জনকে শহরের পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। এই গণহত্যা হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নির্দেশে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি হত্যার মূল হোতা ছিলেন তিনি।এক নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলানা নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিনউদ্দিন আহমেদ, এটি সাদীসহ ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের 'খ' অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সব মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নির্যাতনের যৌথ এবং একক কর্মকাণ্ডের দায়ভার গোলাম আযমের। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর মাধ্যমে যা কিছু পরিচালিত হয়েছে, তার সব হয়েছে গোলাম আযমের মূল নেতৃত্বে। সব ঘটনার জন্য মূলত তিনিই দায়ী। তিনিই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরের ৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। এ ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক করেন গোলাম আযম। ১ ডিসেম্বর সেখানে আবারও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে দমনের জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। দুই নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারাদেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। এরপর ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে একিউএম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে গোলাম আযমের উপস্থিতিতে শান্তি কমিটির সভা হয়। খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে ওই সভায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। তিন নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৭ এপ্রিল গোলাম আযম এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে 'ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী' আখ্যায়িত করে তাদের ধ্বংস করার আহ্বান জানান। ২২ এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে গোলাম আযমের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংগঠনগুলোর সদস্যদের 'দেশপ্রেমিক নাগরিক' উল্লেখ করে দেশের নাগরিকদের ধ্বংস করার আহ্বান জানানো হয়। ১৭ মে গোলাম আযম ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে 'রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ' এবং মুক্তিযোদ্ধাদের 'বিশ্বাসঘাতক' আখ্যায়িত করেন। সেই সঙ্গে ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় তারও প্রশংসা করেন জামায়াতের তখনকার আমির। এরপর ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ আগস্ট খুলনা, ৭ আগস্ট কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন গোলাম আযম। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদি দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, ১৭ ও ২৩ আগস্ট দলীয় সভায় এবং ২৬ আগস্ট পেশোয়ারে জামায়াতে ইসলামীর অনুষ্ঠানেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের শরীরচর্চা কেন্দ্রে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করে তাদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানান গোলাম আযম। ৩ অক্টোবর ঢাকায় জামায়াতের মজলিসে শূরার সভায় একই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন তিনি। চতুর্থ অভিযোগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গোলাম আযমসহ অন্যরা একাত্তরের ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। গোলাম আযমের সহযোগিতায় ৯ এপ্রিল নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এরপর ১৫ এপ্রিল এর নাম বদলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি। ১৮ জুন পাকিস্তানের লাহোর বিমানবন্দরে গোলাম আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে তিনি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে জামায়াতের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে 'দুষ্কৃতকারী'রা সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধে ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র হওয়া উচিত। | false |
rn | জলের সন্তরন- (এক) অনেক গুলো সাপ মিজানের শরীরের সাথে প্যাঁচিয়ে আছে। কুচকুচে কালো বিচ্ছিরি রকমের সাপ গুলো। মিজান ছোটবেলা থেকেই সাপ খুব ভয় পায়। একবার মৌচাক মার্কেটের সামনে একদল মহিলা সাপুড়েরা মিজানের সামনে এসেছিল। মিজান রিকশা করে মগবাজার যাচ্ছিল। জ্যামের কারনে রিকশা থেমে ছিল। সাপুড়েদের দেখে মিজান লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে এক দৌড়ে মগবাজার চলে গিয়েছিল। গলার কাছে প্যাঁচিয়ে থাকা একটা সাপ মিজানকে বলল- স্যার, আপনি ভয় পাবেন না। আপনার কোনো ক্ষতি আমরা করবো না। আমাদের কে বলা হয়েছে- আপনার গায়ে প্যাঁচিয়ে বসে থাকতে। হচ্ছে কি ? সাপ কি করে কথা বলছে? এটা কি স্বপ্ন? মিজান স্বপ্ন দেখছে? মিজান চেষ্টা করছে- স্বপ্ন থেকে বের হতে। পাশ ফিরতে গিয়েই মিজানের ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গার পর মিজান নিজের উপর নিজে খুব রাগ করলো। এইরকম ভিত্তিহীন স্বপ্ন দেখার মানে কি? অবশ্য ঘুমের মধ্যে মানুষ তো ইচ্ছা করে স্বপ্ন দেখে না, কে জেনো দেখায়। মিজান দাঁত ব্রাশ শেষ করে, অনেক সময় নিয়ে গোছল করলো। এখন তার আগুন গরম এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এ বাসায় চা বানানো হয় না। বছরে দুই তিন বানানো হয়। বাসার সবাই এমন ভাব করবে, তারা খুব ব্যস্ত। তবে ভাবীকে খুব করে অনুরোধ করলে চা বানিয়ে দিবেন। মাকে বললে, মা বলবেন, বাবা যা দোকান থেকে কিনে নিয়ে আয়- আমিও এক কাপ খাই। চায়ের ব্যাপার টা খুব অদ্ভুত, একবার মাথার ভেতর ঢুকে গেলে- চা না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি নাই। বাসা থেকে বের হতেই তমা ভাবীর সাথে দেখা। ভাবী পরীকে ডিম খাওয়াচ্ছেন। এই ডিম খাওয়ার দৃশ্য খুবই বিচ্ছিরি। তমা ভাবী মাসীকে বললেন- পরীকে মাম খাইয়ে দাও। ( মাসী এই বাসায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছে, মাসীর নাম মরিয়ন কিন্তু সবাই তাকে মাসী বলেই ডাকে।) ভাবী কঠিন গলায় বললেন, মিজান আজ তুমি হিমির সাথে অবশ্যই দেখা করতে যাবে। মিজান বলল, আচ্ছা। হিমি আমাকে কাল সন্ধ্যায় বেশ কয়েকবার ফোন করেছে, আমি তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি। মিজান চলে যাচ্ছিল, তমা ভাবী বললেন- আজ আমি একটা নতুন জামা পড়েছি- তুমি কিছু বললে না যে ! মিজান বলল, ভাবী আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। মিজান হোটেলে গিয়ে আরাম করে নাস্তা খেল। নাস্তা খাওয়ার পর এক কাপ চা। এখন সে আরেক কাপ চা খাবে, সাথে সিগারেট। প্রথম চা-টার সাথে সিগারেট খায়নি। হোটেল থেকে বের হয়ে আর বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করল না মিজানের। বেকার হওয়ার এই এক সুবিধা। কোনো কিছুতেই কখনও তাড়া থাকে না। সে এখন ইচ্ছা করলেই টঙ্গী চলে যেতে পারে বাসে করে, অথবা ট্রেনে করে গাজীপুর। জানালার পাশে সিট নিয়ে, রাস্তার নানান দৃশ্য দেখতে দেখতে। অবশ্য সে ইদানিং রাস্তা-ঘাটে পরিচিত মানুষদের এড়িয়ে চলে। পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে গেলেই- তারা আফসোস শুরু করে দেয়। তোমার সব বন্ধুরা কত কি করে ফেলল, তুমি কিছুই করতে পারলে না। তোমার কোনো ভালো চাকরী হচ্ছে না কেন ? কেউই বুঝতে চায় না, যে মিজান চাকরীর কাঙ্গাল না। সবাইকেই চাকরী করতে হবে এমন কোনো কথা আছে? থাক না, দুই এক একজন ছন্নছাড়া। মিজান একটা খবরের কাগজ কিনল। এখন সে কোথাও বসে আরাম করে খবরের কাগজ পড়বে। একটা দৈনিক পত্রিকাতে কত রকমের যে খবর ছাপায়! মিজান সব খবর খুব মন দিয়ে পড়ে। কোনো কিছুই বাদ দেয় না। দুই ইঞ্চি একটা বিজ্ঞাপনও সে আগ্রহ নিয়ে পড়ে। পত্রিকা শেষ করে মিজান দেখলো আড়াইটা বেজে গেছে। এবং খুব ক্ষুধা পেয়েছে। পকেটে অল্প কয়েকটা টাকা আছে, এই টাকায় হোটেলে খাওয়া যাবে না। তবে রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে রুটি কলা খাওয়া যাবে। সমস্যা হলো দুপুরবেলা গরম ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। ধোয়া উঠা গরম ভাত। সাথে ডিম সহ ইলিশ মাছ, ডাল ভর্তা আর ঝাল মুরগীর মাংস। মিজান নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করে, কারন এই পৃথিবীতে একজন মেয়ে আছে, যে মিজান কে দেখা মাত্র বলবে- মুখটা শুকনা কেন ? নিশ্চয়ই দুপুরে কিছু খাওনি। চুপ করে টেবিলে বসো, আমার সামনে বসে আরাম করে খাবে। কোনো কথা না। মেয়েটির নাম হিমি। মিজান রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো। আকাশের অবস্থা ভালো না। আকাশ ভরা মেঘ। যেকোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামবে। মিজানের ইচ্ছা করছে রিকশায় করে বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু পকেটে টাকা নেই। মিজান মনে করতে চেষ্টা করছে রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টি নিয়ে কোনো গান। মনে পড়ছে না। হিমিকে জিজ্ঞেস করলে হিমি চট করে বলে দিতে পারত। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ কি কখনও খালি পকেটে একা একা রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন ? গত তিন ধরে আকাশ কালো হয়ে আসছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। হিমির সাথে দেখা হলে স্বপ্নের কথাটা বলতে হবে। স্বপ্নে সাপ দেখলে কি হয়- হিমি বলে দিবে। এবং খুব সুন্দর একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করাবে। মিজান হিমির বাসায় যাওয়ার পর ঝুম বৃষ্টি নামলো। হিমি মিজানকে দেখে একটুও অবাক হলো না। যেন মিজান আজ আসবে হিমি তা জানতো। মিজান এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে হিমির দিকে তাকিয়ে আছে। হিমি আজ একটা নীল শাড়ি পড়েছে। দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, কপালে একটা নীল টিপ, চোখে মোটা করে দিয়েছে কাজল। মিজান কে দেখে হিমি অনেক খুশি হয়েছে। আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেছে। বুকের মধ্যে যেন কেমন করছে। মিজানকে দেখলেই হিমি অস্থিরবোধ করে। মিজান বলল, দাঁড়িয়ে আছো কেন, বসো। হিমি বসে বলল- আজ তুমি আসবে এটা আমি জানতাম। মিজান বলল- কিভাবে? হিমি বলল গতকাল রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। তুমি আসবে বলেই আজ শাড়ি পরেছি। সেজেছি। মিজান পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে হিমির হাতে দিল। হিমির সাথে দেখা হলেই- মিজান চিঠি দেয়। মিজান খেতে বসেছে। রান্না খুব ভালো হয়েছে। ডিম সহ ইলিশ মাছ, ডাল ভর্তা আর ঝাল মুরগীর মাংস। মিজান আরাম করে খেল। হিমি বলল, কতদিন আর এভাবে ঘুরে বেড়াবে? এবার চাকরী খোঁজো। মিজান হাসলো, কিছু বলল না। হিমির ইচ্ছা করছে- মিজানের গালটা একটু ছুঁয়ে দিতে। লজ্জার কারনে পারছে না। মিজান বলল আজ যাই। পরে আবার দেখা হবে, কথা হবে। হিমি বলল, আচ্ছা। কিন্তু হিমির বলতে ইচ্ছা করছে- খবরদার তুমি যাবে না, তুমি আমার সামনে চুপ করে বসে থাকো। আমি তোমার চুল আচড়ে দিবো। ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই মিজান দরজা খুলে বের হয়ে গেল। একবারও পেছন ফিরে তাকালো না। যদি পেছন ফিরে তাকাতো, তাহলে দেখতে পেত- হিমি চোখ ভর্তি পানি নিয়ে মিজানের দিকে তাকিয়ে আছে। রাত এগারো টায় হিমি বিছায় শুয়ে মিজানের চিঠি পড়ল। বাইরে তখনও ঝুম বৃষ্টি। যতবার হিমি মিজানের চিঠি পড়ে, ততবার তার চোখ ভিজে উঠে। হিমির বড় খালা, হিমির বিয়ে ঠিক করেছে। হিমি ঠিক করে রেখেছে, মিজানকে ছাড়া সে আর কাউকে বিয়ে করবে না। মিজানের সমস্যা হচ্ছে মিজান বেকার। হিমি বিশ্বাস করে মিজানের ভালো চাকরী হবে। তারপর তারা বিয়ে করবে। ছোট দুই রুমের একটা বাসা থাকবে তাদের। বাসাটা হিমি নিজের মনের মতন করে সাজাবে। এক সময় তাদের সংসারে নতুন একটা বাবু আসবে। বাবুর নামটাও হিমি ঠিক করে রেখেছে। হিমি চিঠিটা আবার বের করলো। ঘুমাবার আগে সে আরেকবার চিঠিটা পড়বে। মিজান সুন্দর করে চিঠি লিখতে জানে না। চিঠির মধ্যে কোনো আবেগ-ভালোবাসা থাকে না। তবুও চিঠি পড়লে হিমির চোখ ভিজে উঠে। কেন এমন হয় ? হিমি, বেশ কয়েকদিন ধরে রাতে ঘুমুতে পারি না।ঘুমুলেই সাপ স্বপ্নে দেখি। তুমি তো জানো আমি সাপ খুব ভয় পাই। সাপ গুলো আমার গলা প্যাচিয়ে বসে থাকে। এর মধ্যে একটা সাপ আবার- আমাকে স্যার বলে ডাকে। টুকটাক কথা বার্তা বলে। আমাকে ভয় না পাওয়ার আশ্বাস দেয়। সাপের আশ্বাস পেয়ে আমার অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। কি করলে সাপ থেকে মুক্তি পাবো, আমাকে জানাও। ইতি, মিজান। ( চলবে...) সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১:১৫ | false |
hm | খুবরগুড়ে . . . এইভাবে হতে থাকে ক্রমাগত কেউ মারে কেউ মার খায় ভিতরে সবাই খুব স্বাভাবিক কথা বলে জ্ঞানদান করে এই দিকে ওই দিকে তিন চার পাঁচ দিকে টেনে নেয় গোপন আখড়ায় কিছু বা গলির কোণে কিছু অ্যাসফল্ট রাজপথে সোনার ছেলেরা ছারখার অল্প দু চারজন বাকি থাকে যারা তেল দেয় নিজের চরকায় মাঝে মাঝে খড়খড়ি তুলে দেখে নেয় বিপ্লব এসেছে কতদূর এইভাবে, ক্রমাগত এইভাবে, এইভাবে ক্রমাগত। (ক্রমাগত, শঙ্খ ঘোষ) বিল্লালের সঙ্গে বিপ্লবের কোনোদিন দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না। বিল্লাল নম্র স্বভাবের নিরীহ আরামপ্রিয় মানুষ। তার প্রতিবেশী আর সহপাঠীদের মধ্যে যারা বিভিন্ন সময়ে বিল্লালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রেখেছে, তাদের অনেকেই শহুরে জীবনের নানা মোলায়েম ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যাওয়ার ফলে "টাফ" হয়েছে, যেভাবে কাঁচা লোহা হাঁপরে চুল্লিতে আগুনে পানিতে গরম আর ঠাণ্ডা হয়ে পেকে ইস্পাত হয়। বিল্লাল তেমনটা পারেনি। তার রমণীকুশল বন্ধুদের সঙ্গে অনিয়মিত আড্ডায় আর মাঝে মাঝে দৈনিক কচুবনে নারীপুরুষ সিরিজে নারী ও পুরুষ সম্পর্কে নানা তাত্ত্বিক আলোচনায় নারীর কথা মাথায় রেখে পুরুষের টাফ হওয়ার প্রয়োজনের কথা ঘুরে ফিরে বার বার উঠে এলেও বিল্লাল সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত জীবনটায় অনুভব করেছে, টাফের মতো টাফ সে নয়। হয়তো জীবনে সে কখনো টাফ হতেও পারবে না। আর বিপ্লবের সঙ্গে দেখা হতে গেলে মানুষকে একটু টাফ তো হতেই হবে, এটা তো সহজেই অনুমেয়। পেলব লোকজন কি বিপ্লব করে কখনো? কিন্তু পেলব বিল্লালের সঙ্গেই বিপ্লবের দেখা হয়ে যায় প্রকৃতির খসড়াখাতার মার্জিনে লেখা অমোঘ নিয়মে। বিপ্লব অবশ্য তখন এক টং দোকানের সামনে পেতে রাখা প্লাস্টিকের টুলে বসে ঘোলা চীনামাটির কাপে চা খেতে খেতে হাপুস নয়নে কাঁদছিলো। বিল্লাল বিপ্লবের পরিচয় প্রথমে ঠাহর করতে পারেনি। তার কাছে চে গেবারা বিপ্লবের সমার্থক, তাই বিপ্লবের চেহারা অনেকটা চে গেবারার মতো হওয়া বাঞ্ছনীয়, এমনটাই সে ধরে নিয়েছিলো। বিপ্লবের গায়ে চে গেবারার চেহারাখচিত একটি টিশার্ট, তার ওপরে একটা বহুলসংখ্যক পকেটোলা হাতাছাড়া জ্যাকেট আর নিম্নাঙ্গে জিন্স বা কর্ডুরয়ের প্যান্ট থাকবে, পায়ে থাকবে একজোড়া ঈষৎ কাদামাখা বুট, এমন একটা ধারণাও উপযুক্ত কারণ ছাড়াই তার মনে জায়গা করে নিয়েছিলো। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দুলিয়ে মুখে জন হ্যানিবল স্মিথের মতো সিগার কামড়ে ধরে বিপ্লব হোহো করে হেসে উঠে তার পাঁচশো সিসি নরটন মোটর সাইকেলে চড়ে দূরান্তের উদ্দেশে যাত্রা করবে, আকাশে তখন মেঘ গুড়গুড় করে উঠবে, দর্শক থেকে নিরাপদ দূরত্বে বাজ পড়বে কোনো অভাগার ঘাড়ে, দশ-বারো সেকেণ্ড পর বাতাসে ভেসে আসবে তার মন্দ্রধ্বনি, আর দমকা বাতাসে রাস্তায় পড়ে থাকা বিড়ির প্যাকেট, সেলোফেনের টুকরো, দিয়াশলাইয়ের কাঠি পাক খাবে, আর রাস্তা ধরে ক্রমশ দিগন্তপটে ছোটো হয়ে মিলিয়ে যাবে মোটরসাইকেলের পেছনবাতি, এমন সব নাটুকে কল্পনা তছনছ করে বিপ্লব একটা ময়লা সুতির পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে কাঁদতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলো। দেখতে বিপ্লব মোটেও চে গেবারার মতো নয়। জুলফিতে পাক ধরেছে, মাথায় চুল পাতলা হয়ে এসেছে, আর সবচেয়ে আপত্তিকর হচ্ছে, তার বয়সটাও যুবকোচিত নয়। তাই যখন চায়ের কাপে চুমুকের ফাঁকে পাঞ্জাবির হাতায় নাক মুছে বিপ্লব বিল্লালকে জানালো, সে বিপ্লব, পরিচয়টুকু বিল্লালের বিশ্বাসের গালে যেন চড় কষিয়ে দিয়ে গেলো। বিপ্লব বুড়ো? বিপ্লব শুধু বুড়োই নয়, রোগাও। তার অভুক্ত মুখটা তাই প্রথম দেখায় মনের উপরিতলে অভক্তিই জাগিয়ে তোলে। তবে সে অভক্তিকে পরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভেতর থেকে উঠে আসা অনুকম্পার ঢেউ। বিল্লাল তাই টংদারকে চায়ের সঙ্গে কয়েকটা সিঙারাও দিতে বলে। প্লাস্টিকের বয়াম থেকে হতাশাজনক রকমের ছোটো আকারের সিঙারা বার করে একটা প্লাস্টিকের থালার এক কোণে কুমড়োর সস ঢেলে টংদার যখন বিল্লালের দিকে বাড়িয়ে দেয়, বিপ্লব সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে একটা সিঙারা তুলে নিয়ে কামড়ে খায়। বিল্লাল আরেকটা টুল টেনে নিজের আর বিপ্লবের মাঝামাঝি সুবিধাজনক দূরত্বে রেখে প্লেটটাকে সমীহভরে একটু ঠেলে দেয় সে টুলের ওপর। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, "কী হয়েছিলো বলুন তো?" বিপ্লব প্রথম সিঙারাটাকে তুমুল গতিতে শেষ করে দ্বিতীয় সিঙারা তুলে নিয়ে অন্য হাতে চায়ের কাপটাকে ঠেলে দেয় টংদারের দিকে। বলে, "আরেক কাপ চা হোক, কী বলো?" বিল্লাল মাথা ঝোঁকায়। হোক আরেক কাপ, ক্ষতি কী? তার কাছে কিছু টাকা আছে, হাতে সময়ও আছে। সবচেয়ে বড় কথা, সে বিপ্লবের দেখা পেয়েছে, প্রয়োজনমাফিক টাফ না হয়েও। তার রমণীমোহন বন্ধু শুকবর যতোই রাফ অ্যান্ড টাফ হোক না কেন, বিপ্লবকে চা-সিঙারা খাওয়ানোর সুযোগ তো সে পায়নি। দৈনিক কচুবনের নারীপুরুষ সিরিজের নারীদের ফিতায় বিল্লালের টাফনেসের আস্তিন কোনোদিনই ২৬ ইঞ্চি পর্যন্ত যাবে না, কিন্তু বিপ্লবের দেখা তো সে-ই পেলো শেষ পর্যন্ত? টংদারের হাত থেকে নিয়ে বিপ্লব আবার কাপে চুমুক দিয়ে চুক চুক করে চা খায়। সিঙারাগুলো টপাটপ ফুরিয়ে আসে ছুটির দিনের মতো। বিল্লাল নিজের চায়ের কাপে রয়েসয়ে চুমুক দেয়। "উমর আল বদরের কাছে গিয়েছিলাম," খিদেটাকে একটু বাগে এনে বলে বিপ্লব। "ভাবলাম, এসেই যখন পড়েছি, দেশের সবচেয়ে পাকনা বিপ্লবীর কাছে যাই।" বিল্লাল সন্তর্পণে টংদারের দিকে খালি প্লেটটা বাড়িয়ে ধরে ইশারা করে। প্লাস্টিকের বয়াম ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে উঠে আসে আরো কয়েকটি কৃশকায় সিঙারা। বিল্লাল একটা মুখে দেয়, বিপ্লব দেয় দুটো। "উনি ঘুমোচ্ছিলেন।" সিঙারা চিবাতে চিবাতে অভিমানভরে বলে বিপ্লব। "ভোর বেলা গিয়েছিলেন?" বিল্লাল শুধায়। "না। দিনে দুপুরে। নিজের শোবার ঘরে শুয়ে সে দিব্যি ঘুমাচ্ছিলো। আমি পানির পাইপ বেয়ে তার ঘর বরাবর উঠে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি, ফ্যান ঘুরছে সিলিঙে, ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে তার বাতাসে, আর বিছানায় শুয়ে নাক ডাকাচ্ছেন উনি। আমি তাকে ফিসফিসিয়ে ডাকলাম, ও বদর সাহেব, উঠুন, আমি এসেছি। তার আর ঘুম ভাঙে না।" বিল্লাল সিঙারা খায় আর বলে, "তারপর?" বিপ্লবের চেহারাটা অভিমানে ভরে ওঠে। "ওঠে না তো আর ওঠেই না। কয়েক বার ডাকার পর গোঁ গোঁ করে স্বপ্নের ঘোরে কী যেন বকে বকে উল্টো পাশ ফিরে শুলো সে। শেষে আমি জানালার গ্রিলের ভেতর হাত গলিয়ে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মেরে বললাম, উমর আল বদর, আমি ডাকিতেছি তুমি ঘুমাইছো নাকি?" বিল্লাল বিপ্লবের অভিমানের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পেয়ে যায়। বলে, "সে কী?" বিপ্লব আরেকটা সিঙারার আলুতে গুঁজে অভিমানটুকু পিষে মারতে চায়। বলে, "লোকটা ধড়ফড়িয়ে উঠেই আমাকে গালাগালি করতে লাগলো। আমি যতোই বলি, আমি বিপ্লব, চিনতে পারো হে ... সে ততোই ক্ষেপে ওঠে। দুপুর বেলা তার ভাতঘুমটা ভাঙালাম কেন, কোন অধিকারে পানি ছুঁড়ে মারলাম, নিউমোনিয়া হলে কে বাঁচাবে আর কে পথ্যবদ্যির বিল দেবে, এইসব বুর্জোয়া কথাবার্তা শুরু করে দিলো। আমি তাকে যতোই পরিচয় দিয়ে বলি, আমি বিপ্লব, এসে পড়েছি, ওঠো তুমি, প্যান্টটা পরে নাও, এখন অনেক কাজ অনেক দৌড়ঝাঁপ, অনেক অনেক পাহাড় ঠেলা বাকি, সে ততোই বলে, আমিই সব নষ্টের গোড়া, নইলে ১৯৭৩ সালেই সে কী যেন একটা করে ফেলতো। আমার কারণেই নাকি জাবদুল হক আর মোহাব্বত তোহাকে সে বাগে আনতে পারেনি। আর আমিই নাকি ভুলিয়ে ভালিয়ে নিলাজ শিকদারকে লেলিয়ে দিয়েছিলাম তার পেছনে। নইলে সে নাকি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া বামকে এক জায়গায় জড়ো করে এনে ...।" বিপ্লবের গলা বুঁজে আসে। "জড়ো করে এনে?" বিল্লাল জাবদুল হক আর মোহাব্বত তোহার নাম শোনেনি, নিলাজ শিকদারের নামটা মাঝে মাঝে বাতাসে ভাসতে শুনেছে সে। বিপ্লব চায়ের কাপে নীরবে চুমুক দিয়ে বলে, "জড়ো করে এনে ... বিপ্লব করতো।" বিল্লাল মাথা চুলকায়। "তাহলে কী রকম হলো ব্যাপারটা? বিপ্লবের কারণে উমর আল বদর সাহেব আর বিপ্লব করতে পারেননি?" বিপ্লবও মাথা চুলকায়। "অনেকটা সেরকমই। আমি এদিকে পানির পাইপ ধরে কোনোমতে তার জানালা বরাবর আটকে আছি, আর সে বসে বসে আমাকে গালমন্দ করছিলো। আমি যতোই তাকে বলি, কিছু দোষ তারও ছিলো, নইলে কেন সে ফণী সিংহ আর ধ্যান চক্রবর্তীকে বাগ মানাতে পারেনি ... ততোই সে আরও ক্ষেপে উঠছিলো। শেষটায় আমাকে মুখের ওপর শেখ মুজিবের চামচা ডেকে এক রকম গলাধাক্কা দিয়ে জানালা থেকে হটিয়ে, জানালা বন্ধ করে, পর্দা টেনে আবার সে ঘুমোতে চলে গেলো।" বিপ্লবের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে শেষে। বিল্লাল কী বলবে বুঝতে না পেরে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। বিপ্লব টংদারের প্লাস্টিকের জগ থেকে ঢেলে প্লাস্টিকের গ্লাসে করে ঢক ঢক করে পানি খায়, তার কণ্ঠার হাড় ওঠে নামে, কিছু পানি গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে। বিল্লাল চেয়ে দেখে, সিঙারার প্লেট ফাঁকা। বিপ্লব পাঞ্জাবির হাতায় মুখ মুছে বলে, "আর কেউ আছে?" বিল্লাল বলে, "আর কেউ মানে?" বিপ্লব মিটমিট করে তাকায় তার দিকে। তার বসে যাওয়া, কালিপড়া চোখে টিমটিম করে জ্বলে আশার আলো। এদিক সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে গলা নামিয়ে সে বলে, "বিপ্লবী কেউ আছে আর?" বিল্লাল চায়ের কাপ আর সিঙারার প্লেট টংদারকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে, "বিপ্লবী? মানে ... বাম?" বিপ্লব মাথা ঝাঁকায়। "আছে আর?" টংদার বিরস গলায় বলে, "বেয়াল্লিশ টেকা।" বিল্লাল মানিব্যাগ বার করে টাকা মিটিয়ে দিয়ে বিপ্লবকে বলে, "চলেন আমার সাথে।" রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা, অল্প কয়েকটা বাস চলছে, তাতে দুরুদুরু বুকে বসে অনন্যোপায় খেটে খাওয়া মানুষ। বাতাসে জমে থাকা শঙ্কা চিরে নিরাপদে জীবিত ও অদগ্ধ অবস্থায় প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে পড়ে বিল্লাল আর বিপ্লব। বিপ্লব অবশ্য সারাটা রাস্তা আনমনে জানালার পাশে বসে ঢুলছিলো, বিম্পিজামাতের পাণ্ডারা মলোটভ ককটেল মেরে বাসে চড়ার অপরাধে তাকে পুড়িয়ে খুন করবে, এই দুর্ভাবনা তাকে খুব একটা স্পর্শ করেছে বলে বিল্লালের কাছে মনে হয়নি। বিল্লাল মনে মনে বিপ্লবের প্রশংসা করে। হাজার হোক, বিপ্লব বলে কথা। প্রেস ক্লাবের সামনে চোখ ডলতে ডলতে বিপ্লব ডানে বামে তাকিয়ে বিপ্লবী খোঁজে। মনমতো কাউকে দেখতে না পেয়ে সে বিল্লালকে বলে, "কই?" বিল্লাল বিপ্লবকে আঙুল তুলে সামনের দিকে দেখায়। বিপ্লব গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাগত মানুষের ছোটো জটলার দিকে। প্রথম জটলাটি কুড়ি-পঁচিশজনের। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির নিচে ম্যাজেন্টা রঙের স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক এক হাত পেছনে ভাঁজ করে আরেক হাত উঁচিয়ে বলছিলেন, "এই সাম্রাজ্যবাদী সরকারের হাতে এ দেশ নিরাপদ নয়। এরা বেলা শেষে সাম্রাজ্যবাদের সহচর। কিন্তু বিরোধী দলও ভারি দুষ্টু। তারাও সাম্রাজ্যবাদেরই সহচর। সাম্রাজ্যবাদের দালালির টেণ্ডার নিয়ে দুই সহচরে লেগেছে সংঘাত, মাঝখান দিয়ে জনতার অবস্থা হালুয়া টাইট। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই।" একটা মৃদু হাততালির রোল ওঠে সমাবেশের সামনে সমাগত মানুষদের মাঝে। তাদের পরনে ধবধবে সাদা কিন্তু অস্বচ্ছ পাঞ্জাবি। তবে তাদের পাঞ্জাবির গলায় বগলে ঘামের পিঙল দাগ। বিপ্লব সেই ভিড়ের পেছন থেকে হঠাৎ হেঁকে বলে, "আনজিরুল মহসিন খান সাহেব, ফণী সিংহের শিষ্য হয়ে আজ তুমি এ কথা বলছো? হ্যাঁ? সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই? সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মাঝে সমঝোতা হলে প্রোলেতারিয়েতের লাভটা কী?" ভাষণরত বিপ্লবী ভদ্রলোক উসখুস করে ওঠেন। তিনি আবার ভাষণ চালু করেন, "এ দেশের মালিকানা খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণের, সংবিধানে তেমনটিই বলা আছে। কিন্তু সেই জনগণ যখন তাদের দেখভালের জন্য সাম্রাজ্যবাদের দালালদের ক্ষমতায় পাঠায়, তখন সংবিধান হয়ে পড়ে এক টুকরো তুচ্ছ দস্তাবেজ ...।" বিপ্লব তার পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে হাত উঁচু করে গর্জে ওঠে, "আনজিরুল মহসিন খান, রাখো তোমার সংবিধান! সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মধ্যে সমঝোতা করে কী হবে আগে বলো! লেনিন কি সমঝোতা করেছিলেন? মাও কি সমঝোতা করেছিলেন? ফিদেল কাস্ত্রো কি সমঝোতা করেছিলেন? হো চি মিন কি সমঝোতা করেছিলেন?" আনজিরুল মহসিন খান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলেন, "ইয়ে ... কী যেন বলছিলাম, এখন দেশে যা চলছে, তা হচ্ছে চর দখলের সংস্কৃতি ...।" বিপ্লব তবুও বাঘের মতো গর্জায়, "বলো, কবে কোন বিপ্লবী সমঝোতা করেছিলেন?" আনজিরুল মহসিন খান এবার চটে গিয়ে বলেন, "আরে কী জ্বালা, শান্তিতে দুইটা বক্তব্য দিতে পারবো না নাকি? কে রে ভাই, হট্টগোল করো?" বিপ্লব তবুও বার বার নেহারির ঝোলের মতো টলটলে ভিড়ের ভেতর থেকে তড়পায়, সমঝোতা করা বিপ্লবীর নাম জানতে চায়, সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মাঝে বিম্পি নেতা নিজামরুল ইসলাম খান কেন আনজিরুল মহসিন খানের ভায়রা, সে কথা জানতে চায়। আনজিরুল মহসিন ফুঁপিয়ে ওঠে, "আরে বাল আমি কি দুনিয়ার সব বিপ্লবীকে চিনি? এই ডালিম, তোমার হাতে পার্টি দিলাম, কী লোকজন ঢুকাইছো পার্টিতে? এইসব কী কোচ্চেন করে?" জিহাদুল আসলাম ডালিম চেয়ারে বসে বসে ঢুলছিলেন, আনজিরুল মহসিনের খোঁচা খেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে তিনি বলেন, "সব সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত। এ সংঘাত সাম্রাজ্যবাদের খেয়ে যাওয়া রোস্টের ফেলে যাওয়া হাড্ডির টুকরার দখল-বখরা নিয়ে সংঘাত। জনগণ এ সংঘাত চায়নি, চায় না। সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই ...।" আনজিরুল মহসিন খান আবার খোঁচান, "আরে এই লোক এগুলি কী জিগায়?" জিহাদুল আসলাম ডালিম হাত নাড়ে, "এই লোক, চলে যাও। চলে যাও এখান থেকে। সাম্রাজ্যবাদের দালালি ছেড়ে দাও। সংঘাত কোরো না। সমঝোতা চাইলে এসে বসো, বক্তৃতা শোনো। ডাস কাপিটাল পড়েছো?" বিপ্লব শূন্যে মুষ্ঠি হেনে বেরিয়ে আসে সে ভিড় থেকে, পিছু পিছু বিল্লাল। বিপ্লব বিড়বিড় করে জোর পা চালিয়ে সামনে এগোতে থাকে। "ফণী সিংহের শিষ্য এরা? এদের হাতে পার্টি? কীভাবে আসবো এ দেশে? কারা আনবে আমাকে? এরা তো আমাকে খেদিয়ে দিচ্ছে।" বিল্লাল চুপচাপ পিছু পিছু হাঁটে। সে দেখতে পায়, সেই দুবলা রোগাটে ভাবটা বিপ্লবের শরীর থেকে চলে গেছে। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা চিতাবাঘের মতো বিপ্লব গটগট করে যেন হেঁটে চলে ইতস্তত ভেড়ার পালের মাঝে। কয়েক কদম এগোতেই চোখে পড়ে আরেক জটলা। সেখানে আঙুল উঁচিয়ে এক প্রৌঢ় বিপ্লবী গর্জন করে চলছেন। "সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের মোকাবেলা করার আগে নিজেদের প্রস্তুত হতে হবে। আমরা যদি খামোকা অহেতুক হুদা বিতর্কে ব্যস্ত থাকি, আমাদের সংগ্রাম ঢিলা হয়ে যাবে। এ নিয়ে আমি ভ্যানগার্ডের গত সংখ্যায় লিখেছি। কমরেড মনিবুল হালদার ও অসিতাংশু চক্রবর্তী অহেতুক দলকে কমজোর করেছেন। অহৈতুকী বিতর্কে আমাদের দুর্বল করেছেন। পিছিয়ে দিয়েছেন। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমরাই প্রকৃত বাঁশদ। তারা দলত্যাগী মোনাফেক মাত্র।" সমাগত কয়েক ডজন তরুণ তরুণী প্রবল হাততালি দিয়ে চেয়ারে ঢুলতে থাকা এক প্রৌঢ়ের ঘুমের চটকা ভেঙে দেয়। আলেক মওলা দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, "গণচাঁদার টাকায় সম্পত্তি কেনা নিয়ে এতো তর্কের কী আছে? পার্টির সম্পত্তি তো ভূতের নামে থাকতে পারে না। মানুষের মতো মানুষের নামেই তা থাকতে হবে। আর পার্টিতে আমার চেয়ে উপযুক্ত মানুষ কেউ আছে? থাকলে তার নাম শুনতে চাই।" বিপ্লব পেছন থেকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গর্জন করে ওঠে, "বিপ্লবী রাজনীতির প্রাণ, উন্নত চারিত্রিক মান!" আলেক মওলা চটে ওঠেন, "আরে রাখো তোমার উন্নত চারিত্রিক মান। একটু আধটু যৌথ জীবন যাপন করতে না দিলে বিপ্লবীরা থাকবে? সব কয়টাই তো দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর পটাপট বিয়েশাদি চাকরিবাকরি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পগারপার হয়ে যায়। দিনকে দিন বিপ্লবী কমে যাচ্ছে। তার ওপর চরিত্র নিয়ে এতো রশি টানাটানি হলে তো দলই থাকবে না। আবার বিপ্লব!" বিপ্লব এবার লুঙ্গি মালকোঁচা দিয়ে হুঙ্কার দেয়, "কমরেড আলেক মওলা, তুমি কীভাবে বিপ্লব করবে? তোমার হাতে পড়ে বাঁশদ শুধু ভাঙছে আর ভাঙছে। ছাত্রফ্রন্টিয়ারের বিপ্লবীরা আট বছর আগে কে এক নারী কমরেডের বিয়ের আসরে তোমার মুখে চুনকালি দিয়ে বেরিয়ে গেলো, তুমি ভুলে গেছো? দুই বছর আগে জাবদুল্লাহ সরকার তোমার কান মলে দিয়ে চলে গেলেন। আবার তুমি গিয়ে ভিড়েছো ডালিম-আনজিরদের সাথে, মোর্চা থেকেও তোমার দলকে বাকি বিপ্লবীরা খেদিয়ে দিয়েছে। এরপর তুমি কাদের নিয়ে বিপ্লব করবে?" আলেক মওলা ক্ষেপে গিয়ে বলেন, "মনিবুল হালদারের হয়ে দালালি করতে এসেছো আমার মিটিঙে, তাই না? সাম্রাজ্যবাদের দালালদের চেয়ে বড় শত্রু এই মনিবুল হালদারের দালালরা। এই কে আছো কমরেড, ধরো তো এটাকে! কোনো সমঝোতা নাই, সংঘাত করতে এসেছে, দেখিয়ে দাও সংঘাত কী জিনিস!" বিপ্লব খপ করে বিল্লালের হাত চেপে ধরে ছুট লাগায়, বলে, "পালাও!" বিল্লাল হতচকিত হয়ে দৌড়ায়, পেছন পেছন তাড়া করে আসে কয়েকটি উত্তেজিত তরুণী কমরেড। বিপ্লব শ'খানেক গজ ছুটে থামে, থেমে ঘাম মোছে। পেলব বিল্লালের এতো দৌড়ঝাঁপের অভ্যাস নেই, সে ধপ করে ফুটপাথে বসে পড়ে হাঁপরের মতো হাঁপাতে থাকে। সব কিছুই তার কাছে উল্টো মনে হয়। বিপ্লব কেন পালিয়ে যাবে? বিপ্লব যেন বুঝে ফেলে তার মনের কথা। বলে, "পালানো মানেই প্রস্থান নয়। পশ্চাদপসরণ বিপ্লবীর জীবনের নিত্য কৌশল। উমর আল বদরের বাড়ি থেকে তো পশ্চাদপসরণই করলাম, তাই না? সব সময় সবকিছুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকলে বিপ্লব হবে না।" বিল্লাল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই?" বিপ্লব মাথা চুলকায়। "না ... তা তো বলিনি।" বিল্লাল বলে, "তাহলে?" বিপ্লব একটু ক্ষেপে ওঠে। বলে, "সমঝোতা তো পশ্চাদপসরণ নয়। সমঝোতা মানে নেকড়ের পালের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে পাতিনেকড়ে হওয়া। সংঘাত মানে নেকড়ের সঙ্গে লড়াই করা। আর পশ্চাদপসরণ হচ্ছে লড়াইটা আজ না করে কালপরশুর জন্যে রেখে দিয়ে প্রস্তুত হওয়া।" বিল্লাল বড় শ্বাস নিয়ে বলে, "সমঝোতা করে প্রস্তুত হওয়া যায় না?' বিপ্লব মাথা নাড়ে। "না। সমঝোতা মানে লোহা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া। আর লোহা না তাতালে আমার আর আসা হবে না।" বিল্লাল বলে, "তাহলে সামনে আগাই, কী বলেন?" বিপ্লব পা চালায়। কিছু দূরে আরেকটা জটলা শেষ বিকেলের রোদ পোহাচ্ছে। কাছে গিয়ে বিল্লাল বক্তাকে চিনে ফেলে। এনাকে সে টকশোতে নিয়মিত দেখে। সাদামাটা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ফেননিভ খান মেনন, যাকে সবাই একটু মশকরা করে ফেনোমেনন বলে আড়ালে বা প্রকাশ্যে ডাকে, চোখ বুঁজে বলে যাচ্ছিলেন, "স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া আমরা হতে দেবো না। যদিও আমরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের সঙ্গে জোট করেছি, কিন্তু নিজেদের পরিচয়, স্বাতন্ত্র্য, লক্ষ্যকে আমরা বিকিয়ে দিইনি। আমরা খেটে খাওয়াদের দল। আর খেটে খাওয়াদের শত্রুরাই স্বাধীনতা শত্রু। তারা এখন ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে আমাদের গায়ে আগুন দিচ্ছে, বোমা মারছে, রাতে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে মারছে। কীভাবে তাদের এতো স্পর্ধা হলো? এই সাম্রাজ্যাবাদীদেরই প্রত্যক্ষ ও্ পরোক্ষ প্ররোচনায়। এরাই এই কালসাপকে বুকে জড়িয়ে পেলে পুষে বড় করেছে ...।" বিপ্লব অস্থির হয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পোস্টার বার করে আনে, বিল্লাল তাতে উঁকি দিয়ে চমকে ওঠে। মইত্যা রাজাকারকে বুকে জড়িয়ে ধরে তৃপ্তির হাসি হাসছেন ফেনোমেনন। পোস্টারের নিচে লেখা, মাত্র ১৯ বছর পর। ফেনোমেনন কী যেন বকে যাচ্ছিলেন, বিপ্লব গর্জে ওঠে, "এতো খেটে খাওয়া মানুষ থাকতে তোমাকে সাম্রাজ্যবাদের দালালের সঙ্গে জোট করতে হয় কেন? কেন তুমি খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে বিপ্লব করো না? আর এই পোস্টারে এটা কাকে জাবড়ে ধরে বিটকেল হাসছো তুমি, হ্যাঁ?" ফেনোমেনন চুপ করে চশমার ফাঁক দিয়ে ভাবুক চোখে বিপ্লবকে দেখেন। বিপ্লব আবারো তড়পায়, বলে, "আমি সারা দেশ ঘুরে দেখেছি। সেখানে মানুষ খাটতে খাটতে মুখে রক্ত তুলে ফেলছে। কিন্তু তুমি খেটে খাওয়ার দলের নাম ভাঙিয়ে গিয়ে জোট পাকাচ্ছো সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই। লেনিন কি জারের সঙ্গে জোটে ঢুকেছিলেন? মাও? কাস্ত্রো?" ফেনোমেনন অলস হাত নেড়ে বলেন, "য়্যায় কে আছো একটু দেখো তো।" কয়েকজন খেটে খাওয়া রাগী চেহারার যুবক এগিয়ে আসে ভিড় ঠেলে। বিপ্লব চিৎকার করে বলে, "পালাও পালাও!" এবার বিল্লালকে আগের চেয়ে আরো শ'খানেক গজ বেশি ছুটতে হয়, বিপ্লবও একটু হাঁপিয়ে ওঠে এবার। বিল্লাল ফুটপাথের রেলিং ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "আরেকটু হলেই সংঘাত হয়ে যেতো, বাপ রে!" বিপ্লব বলে, "একটু পানি পাওয়া যাবে কোথাও?" বিল্লাল বলে, "নাহ, এদিকটায় তো কিছু নেই, সচিবালয়ের ওদিকে গেলে হয়তো দোকানপাট খোলা পাওয়া যেতে পারে ...।" বিপ্লব জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটে, আর বলে, "আর কেউ নেই?" বিল্লাল কিছু বলতে যাবে, এমন সময় কাছেই একটা মাইক ঘড়ঘড় করে ওঠে, "হ্যালো, হ্যালো, সোনায়েদ জাকি কলিং অল ইনসাফ ড্যুডস, সোনায়েদ জাকি ডাকছে সব ইনসাফিকে, ডু ইউ কপি ড্যুডস?" একটা হুল্লোড় ওঠে কাছেই, "কপি, কপি।" বিপ্লবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে বিল্লালকে টেনে রেলিং থেকে ছাড়িয়ে সামনে এগোয়। "আছে, আরো আছে!" বিল্লাল বিপ্লবকে বুঝিয়ে বলতে চায়, কিন্তু বিপ্লব তাকে টানতে টানতে এগিয়ে যায় সামনের জটলার দিকে। এ জটলা আগের তিন জটলার চেয়ে ঘন, জটলার তরুণরাও অন্যদের চেয়ে বেশি ধোপদুরস্ত। মাইকের সামনে দাঁড়ানো বক্তা সুবেশী, তার চুলগুলো দামি সেলুনে ছাঁটা, পরনে আড়ঙের পাঞ্জাবি আর চাদর। সে বলে, "এতোক্ষণ তোমরা শুনলে আমাদের প্রিয় ইনসাফ সংগ্রামী ফারুক গুয়েবাড়ার মর্মস্পর্শী বক্তৃতা। এখন তোমাদের উদ্দেশে সুন্দরবন নিয়ে কিছু বলবে তোমাদের প্রিয় ইনসাফ সংগ্রামী কলু মুস্তফি। ভাইসব, কলু মুস্তফি।" কলু মুস্তফি নামের তরুণ গটগট করে এগিয়ে আসে মাইকের সামনে। প্রত্যয়ী কণ্ঠে সে বজ্রমুষ্ঠি উঁচিয়ে ধরে বলে, "আমাদের দেশের তেল গ্যাস কয়লার মালিক আমাদের জনসাধারণ। সাম্রাজ্যবাদী টাউট বাটপারের হাতে এসবের মালিকানা আমরা ছেড়ে দেবো না। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা সুন্দরবনের হরিণশিশুকে রক্ষা করবো। সে যাতে তার মায়ের সঙ্গে ভোরবেলা নিশ্চিন্ত মনে চরে বেড়াতে পারে পশুর নদীর পারে। সে যেন বনের ঘাসপাতা চিবিয়ে আর নদীর পানি পিয়ে বড়টি হতে পারে। তারপর একদিন যেন নাদুস শরীরে ভরা যৌবনে সে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের একটি বাংলাদেশী বাঘের হাতেই ঘাড় মটকে মারা পড়ে। এটিই সুন্দরবনের হরিণের সমুচিত নিয়তি। কিন্তু কী হচ্ছে এসব ভাইসব? সাম্রাজ্যবাদের দালাল নব্য রাজাকার আম্লীগ তার শয্যাসঙ্গী ভারতকে নিয়ে সুন্দরবনের মাঝে এ কী গড়ে তুলছে? হরিণশিশুর চোখ দিয়ে দেখুন ভাইসব। দূরে ওটা কীসের ধোঁয়া? নদীতে এটা কীসের কালি? বনের সুস্বাদু টসটসে গাছের পাতায় জমা হওয়া গুঁড়াগুঁড়া ভুসিভুসি এগুলো কী রে? বনের পাশ দিয়ে নদীতে এ কী ভোঁভোঁ শব্দ আর আলো? এ কী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্বন ডায়োক্সাইড? নদীতে এটা কি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য? এ কি গাছের পাতায় জমা কয়লার কাজলরেখা? এ কী কয়লাবাহী জাহাজের ভেঁপু আর বাতি? আমি বেচারা হরিণশিশু রাতে ঘুমাবো কীভাবে? খাবো কী? শরীরে গোস্তো জমবে কী করে? আর শরীরে গোস্তো না জমলে সুন্দরবনের বাওয়ালি মৌয়ালি খাবে কী? আর বাওয়ালি মৌয়ালিরা খেতে না পেলে তাদের শরীরে গোস্তো জমবে কী করে? আর তাদের শরীরে গোস্তো না জমলে সুন্দরবনের বাঘ খাবে কী? আম্লীগ, তুই সুন্দরবনের বাঘ হরিণ সব মারলি।" কলু মুস্তফি কান্নায় ভেঙে পড়ে। বয়স্ক এক সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক দু'পায়ে প্লাস্টার বেঁধে একটি চেয়ারে বসে ছিলেন, তিনি হাততালি দিয়ে বলেন, "কলু মুস্তফি গোটা ব্যাপারটি সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলেছে। সাবাশ ইনসাফি সংগ্রামী, সাবাশ।" কলু মুস্তফি চোখ মুছে ধরা গলায় বলে, "অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বতকে ধন্যবাদ। ঝানু স্যার কিছুদিন আগেই সাম্রাজ্যবাদী ভারতে কীভাবে লোকে কয়লাখনির বিষে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, তা সরজমিন পরখ করে দেখতে গিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ভারত স্যারকে পুলিশ দিয়ে কয়লাখনি থেকে বন্দী করে, তারপর নির্মমভাবে প্রহার করে, অত্যাচার নির্যাতন করে, তাঁকে ডিম দেয়। দেখুন স্যারের পায়ে প্লাস্টার দেখুন।" ঝানু মোহাব্বত প্লাস্টার করা পা দুটি টর্চ লাইট জ্বেলে সকলকে দেখান। ফারুক গুয়েবাড়ার পাশে ভিডিও ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক গম্ভীরবদনা মহিলা সে দৃশ্য ভিডিও করেন। বিপ্লব গর্জে ওঠে, "ডিম দিলে পায়ে কেন প্লাস্টার করতে হবে?" কলু মুস্তফি পাল্টা গর্জন করে, "আরে ডিম দিয়েছে অন্য জায়গায়। সঙ্গে পাও ভেঙে দিয়েছে। ডিমের জায়গার প্লাস্টার কি সবাইকে দেখানো যাবে?" অন্যান্য ইনসাফ সংগ্রামীরাও হুঙ্কার দেয়, "দেখানো যাবে?" ঝানু মোহাব্বত ভুরু কুঁচকে বিপ্লবকে দেখেন আপাদমস্তক। বিপ্লব পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বলে, "ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জামাতশিবিরবিম্পির লোকজন সারা দেশে হাজার হাজার গাছ কেটেছে। সেটা নিয়ে ঝানু মোহাব্বত সরজমিন পরখ করতে যায় না কেন?" ঝানু মোহাব্বত টর্চ নিবিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে অন্য দিকে তাকান। কলু মুস্তফি পাত্তা দেয় না বিপ্লবের কথায়, সে আবার তর্জনী উঁচিয়ে গর্জন করে, "সাম্রাজ্যবাদী ভারতের অত্যাচারের ভয়েই অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত দীর্ঘ তিনটি মাস ধরে সুন্দরবন নিয়ে আর কিচ্ছু বলছেন না। আমরা যারা তাঁর ভাবশিষ্য, আমরাও আপাতত চুপ আছি। কারণ যারা একজন প্রবীণ গবেষককে ডিম দেয়, তারা একজন নবীন গবেষককেও ছাড়বে না। আর দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ভুখা নাঙা আমজনতার মালিকানা বুঝে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইনসাফের জন্য কাউকে না কাউকে তো গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। তাই ভাইসব ...।" বিপ্লব আবারও গর্জায়, "ভুখানাঙা আমজনতার মালিকানাধীন সামাজিক বনায়নের কয়েকশো কোটি টাকা দামের হাজার হাজার গাছই তো জামাতশিবিরবিম্পির লোকজন কেটে নিয়ে সড়ক অবরোধ করেছে। এটা নিয়ে তোমরা কিছু বলো না কেন?" ইনসাফ ড্যুডরা চুপ করে যায়। সোনায়েদ জাকি উদাস মুখে ঘড়ি দেখে, ফারুক গুয়েবাড়া মোবাইলে কাকে যেন কল দেয়, আর ঝানু মোহাব্বত ইতস্তত কাশেন। কলু মুস্তফি কিছুক্ষণ ভাবগম্ভীর মুখে চেয়ে থেকে বলে, "হাজার হাজার গাছ?' বিপ্লব গর্জে উঠে বলে, "হ্যাঁ!" কলু মুস্তফি শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিয়ে বলে, "কয়েকশো কোটি টাকা দাম?" বিপ্লব বলে, "হ্যাঁ!" কলু মুস্তফি পকেট থেকে একটা ক্যালকুলেটর বার করে কী যেন পার্সেন্টেজ হিসাব করে আড়চোখে সোনায়েদ জাকি আর ফারুক গুয়েবাড়ার দিকে তাকায়। তারাও পাল্টা কড়া চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ঝানু মোহাব্বত হাত তুলে গৌতম বুদ্ধের বরাভয় মুদ্রা দেখান তাকে। কলু মুস্তফি ক্যালকুলেটরটিকে পকেটস্থ করে বলে, "হুমমম, আচ্ছা ... বেশ বেশ। এখানে আমাদের বুঝতে হবে, সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় কে। গাছ যে কাটে, সেও প্রোলেতারিয়েত। এখানে জামাতশিবিরবিম্পিকেও ভুখানাঙা আমজনতা ধরতে হবে। তারা নিজেরা নিজেদের গাছ কাটছে। বরং রাষ্ট্রের গলা টিপে ধরা বুর্জোয়া আম্লীগ ঐ গাছগুলিকে যাতে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাচার করতে না পারে, তাই তারা আগাম নিজেদের মাল নিজেরা বুঝে নিয়েছে।" বিপ্লব ঘাবড়ে গিয়ে বলে, "এ কেমন কথা?" সোনায়েদ জাকি বজ্রনির্ঘোষে হাততালি দেয়, "এনকোর, এনকোর!" কলু মুস্তফি উৎসাহ পেয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে, "সুন্দরবনের হরিণশিশু যদি নিজেই সুন্দরবনের মাঝে কয়লাবিদ্যুতের কেন্দ্র খুলে বসতো, আমরা কিছু বলতে পারতাম? চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করবো কী? জামাতশিবিরবিম্পির গাছকাটাকেও সুন্দরবনের হরিণশিশু কর্তৃক সুন্দরবনে কয়লাবিদ্যুৎ খুলে বসা হিসাবে দেখতে হবে। যেহেতু এই গাছগুলো কাটায় ভারতের ক্ষতি হয়েছে, তাই এখানে কোনো সমস্যা হয়নি। সর্বোপরি ...।" সে থেমে যায়। বিপ্লব চিৎকার করে বলে, "ভারতের কীভাবে ক্ষতি হলো?" কলু মুস্তফি আড়চোখে অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বতের দিকে তাকায়, তিনি শব্দ না করে হাততালির ভঙ্গি করেন। ভরসা পেয়ে কলু বলে, "হয়েছে। এটা আপনি বুঝবেন না। অর্থনীতি বলে, ভারতেরই ক্ষতি হয়েছে। ঠিক যেভাবে সুন্দরবনের মাঝখানে সুন্দরবনেরই হরিণশিশু কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র খুললে ভারতের ক্ষতি হতো। জামাতশিবিরবিম্পি এখানে সেই হরিণশিশু।" বিপ্লব বলে, "গাছ কাটলো বাংলাদেশে, টাকা মার গেলো বাংলাদেশের গরিবের, জামাতশিবিরবিম্পির ক্যাডাররা এখানে সুন্দরবনের হরিণশিশু হয় কীভাবে?" ঝানু মোহাব্বত প্লাস্টার চুলকাতে চুলকাতে তৃপ্ত গলায় বলেন, "হয়, হয়, zানতি পারো না!" বিপ্লব তোতলাতে থাকে, "মানে কী এসবের?" কলু মুস্তফি আবার শুরু করে, "সর্বোপরি, এই গাছ কাটা হচ্ছে চাইনিজ কুড়াল ও চীন হতে আমদানি করা বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে। যেহেতু এতে করে দেশের কুড়াল ও করাতের বাজারে সংগ্রামী চীনা ইনসাফি ভাইদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তাই এতে করে ভারতের আবারও ক্ষতি হচ্ছে। অতএব এই সামান্য গাছকাটা নিয়ে আমরা বেশি সময় নষ্ট করবো না। ফিরে যাই সুন্দরবনের হরিণশিশুর জুতো পায়ে দিতে ...।" বিপ্লব লাথি দিয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার উল্টে দিয়ে বলে, "এসব কী বাকোয়াজ? কীভাবে হয়? ব্যাখ্যা কই? প্রমাণ কই? তথ্যসূত্র কই?" কলু মুস্তফি এবার শার্টের হাতা গুটিয়ে চোখ পাকিয়ে শীতল গলায় বলে, "ব্যাখ্যা? প্রমাণ? তথ্যসূত্র? আপনি কোথাকার কোন হরিদাস পাল যে আপনাকে এসব দিতে যাবো? বাংলায় কথা বলি বোঝা যায় না?" ফারুক গুয়েবাড়া দুই পা এগিয়ে এসে ধমক দিয়ে বলে, "বাড়ি কই আপনার? গোপালি?" সোনায়েদ জাকি ধমকে বলে, "য়্যায়, কে আপনি?" অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, "ঐ তুই কে রে?" বিপ্লব এবার সামনে পড়ে থাকা সব প্লাস্টিকের চেয়ার লাথি মেরে ছিটকে ফেলে দিয়ে আকাশ কাঁপানো গর্জনে বলে, "আমি বিপ্লব!" এবার সবাই চমকে ওঠে। ফারুক গুয়েবাড়া কাছে এগিয়ে আসে, সোনায়েদ জাকি পকেট থেকে দূরবীণ বার করে বিপ্লবকে খুঁটিয়ে দেখে, কলু মুস্তফি দ্রুত মঞ্চ ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত বিপ্লবের মুখে টর্চের আলো ফেলেন। বিল্লাল পেছনে অস্ফূট গুঞ্জন শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, আনজিরুল মহসিন, জিহাদুল আসলাম ডালিম, আলেক মওলা, ফেনোমেনন, সবাই গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির। তাদের সবার চোখে অস্বস্তি। ঝানু মোহাব্বত প্লাস্টারমোড়া পা নিয়ে থপথপিয়ে হেঁটে এসে ক্রুদ্ধ বিপ্লবের চেহারাটা টর্চের আলোয় ভালো করে দেখেন। ফারুক গুয়েবাড়া চমকে উঠে সোনায়েদ জাকি আর কলু মুস্তফির পেছনে গিয়ে লুকায়। এক এক করে প্রবীণ বামেরা বিপ্লবকে ভালো করে দেখেন। বিকেল নিংড়ে পৃথিবী শেষ রোদটুকু ঢেলে দেয় বৃদ্ধ বিপ্লবের অবয়বে। ইনসাফিরা অপরাধীর চোখে একে অন্যের দিকে আড়ে আড়ে তাকায়। বড়রা বিড়বিড় করে নিজেদের মধ্যে কথা বলেন, বিপ্লব একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে ধপ করে তার ওপর বসে পড়ে। তাকে আরো বুড়ো দেখায়। বিড়বিড় করে সে বলে, "কতো জায়গায় গিয়েছি আমি! একদিনের জন্যে হলেও গিয়েছি! শুধু ডাক পাই না তোমাদের কাছ থেকে। ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে বসে বসে ভাবি, এই বুঝি ডাক আসে। কীসের কী! তোমরা করবে বিপ্লব? তোমাদের পাঞ্জাবির ভিতর দিয়ে রংবেরঙের নকশা করা গেঞ্জি ফুটে থাকে, এক একজনের পকেটে স্মার্টফোন, হাতে ভিডিও ক্যামেরা, বুক ভর্তি কুযুক্তি টোকা চিরকুট, মুখে হাসি আর মিথ্যা কথা। তোমরা কীভাবে আমাকে ডাকবে? আমাকে ডাকার কেউ নেই।" সবাই বিপ্লবকে ঘিরে ধরে, কিন্তু সে চেয়েও দেখে না। আনমনে বকে যায় নিকারাগুয়ার জঙ্গলে তাকে ডাকতে গিয়ে সামোজার ন্যাশনাল গার্ডের তাড়া খাওয়া কিশোরের গল্প, নেপালের সিমিকোটের পাহাড়ে গুর্খা রেজিমেন্টের মুখোমুখি হওয়া ত্রস্ত কিশোরীর হাতে ধরা স্টেনে শেষ বুলেটটির লক্ষ্য নিয়ে দ্বিধার গল্প, ঝাড়খণ্ডের গহীন অরণ্যে রাজ্য পুলিশের রেইডের মুখে আসন্নপ্রসবা গেরিলার হাত ধরে তার মুখ চেপে ধরে রাখা প্রৌঢ় পিতার শুকনো চোখের গল্প। তার এক একটা এলোমেলো গল্পের কাছে ফিকে হয়ে আসে মাইকে ভেসে আসা অদূরে অন্য কোনো বাম নেতার একঘেয়ে হুঁশিয়ারি, সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান, সংঘাত নয় সমঝোতা চাই, দুনিয়ার মজদুর এক হও এক হও, সোনায়েদ জাকি কলিং ইনসাফি ড্যুডস অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন। অ্যাকশনের কথা শুনে বিল্লালের সম্বিত ফেরে, সে বিপ্লবের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে আশেপাশে তাকায়। দেখে, সবাই ঘিরে ধরেছে বিপ্লবকে। তারপর অ্যাকশন শুরু হয়। আনজিরুল মহসিন খান আর জিহাদুল আসলাম ডালিম মারে ডাস কাপিটাল দিয়ে, আলেক মওলা মারে ভ্যানগার্ডের বাণ্ডিল দিয়ে, ফেনোমেনন মারে দুর্নীতি দুবৃত্তি সাম্প্রদায়িকতার হার্ড কভার দিয়ে, আর ঝানু মোহাব্বত পকেট থেকে বার করে ইস্পাতের মলাটে বাঁধাই করা ফরহাদ মগবাজারের মোকাবেলা। একটু পেছনে দাঁড়িয়ে হ্যা হ্যা করে হাসে আর উৎসাহ দেয় ফারুক গুয়েবাড়া, মার, মার শালারে, মার। বিপ্লব লুটিয়ে পড়ে পথে। বাম নেতারা তাকে জামাতশিবিরের হিংস্রতা নিয়ে মারে। বিপ্লবের গরম রক্ত ছিটকে পড়ে তাদের সফেদ পাঞ্জাবিতে। বিল্লাল শুনতে পায়, দূরে কোথায় যেন ঢাকের কাঠি বেজে উঠেছে। সূর্য অতি দ্রুত মুখ লুকিয়ে আড়াল করতে চায় এই হত্যাকাণ্ডকে, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে কয়েকজন প্রবীণ বামপন্থীর ধবধবে সাদা পোশাকে জ্বলন্ত রক্তের ফোঁটা। বুক ভরা অব্যক্ত গল্প নিয়ে বিপ্লব খুন হয়। পেলব বিল্লাল হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে, আপনারা বিপ্লবকে মেরে ফেললেন? সবাই এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। বিল্লাল ভয় পায় না এতটুকুও। সে আবারও বলে, আপনারা বিপ্লবকে মেরে ফেললেন? এবার বামেরা সবাই নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলাপ করেন। ডাস কাপিটাল, ভ্যানগার্ড, দুর্নীতি দুর্বৃত্তি সাম্প্রদায়িকতা আর মোকাবেলা থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়ে পথে। নিথর স্তুপ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে বিপ্লব। ঢাকের কাঠির গুড়গুড় শব্দ একটু একটু করে আরো জোরালো আর স্পষ্ট হয়। তাকে ছাপিয়ে অধ্যাপক ঝানু মোহাব্বত এবার এগিয়ে এসে মিষ্টি করে বলেন, "কই, না তো?" বিল্লাল হাহাকার করে বলে, "আপনারা বিপ্লবকে মেরে ফেললেন?" ইনসাফ সংগ্রামীরা বিপ্লবের মৃতদেহ চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে রমনা পার্কের এঁদো জলাশয়ের দিকে এগিয়ে যায়। ঢাকের শব্দ সেদিক থেকেই ভেসে আসছে। ক্রমশ সে শব্দের প্রাবল্যে বিসর্জন যাত্রা একটা ছন্দ পেয়ে যায়। অচেনা সংগ্রামীদের কাঁধে চড়ে মৃত বিপ্লব এগিয়ে যায় জলের দিকে। বামেরা সবাই সার বেঁধে দাঁড়ায় ঝানু মোহাব্বতের পেছনে। ঝানু মোহাব্বত হেসে বলেন, "এ বিপ্লব সে বিপ্লব নয়!" [মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাড়েকে নিয়ে কয়েকটা দিন প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। এই গল্পে খোবরাগাড়ে প্রাসঙ্গিক নন। তার নামটা অপ্রচলিত বলে সামান্য বদলে নিয়ে নতুন একটা শব্দ কয়েন করলাম, খুব-রগুড়ে। অর্থাৎ, অনেক রগড় ঘটায় যা, বা রগড় ঘটান যিনি। রগড়ের অর্থের মধ্যে কৌতুক, ঘর্ষণ, পেষণ, ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি আছে ঢাকের কাঠির আওয়াজ।] | false |
hm | গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও বিষ্ণুমূর্তি রহস্য গোয়েন্দা ঝাকানাকা একটি ভুরু উত্তোলন করে দারুণ এক অট্টহাসি দিলেন। দারোগা কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধারি গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। "কেস খুবই সরল।" ঝাকানাকা এক গাল মুড়ি চিবাতে চিবাতে বললেন। "বিষ্ণুমূর্তি আদৌ চুরি যায়নি।" কিংকু চৌধারি বললেন, "কিন্তু ...।" ঝাকানাকা চোখ পাকিয়ে তাকালেন শুধু। কিংকু চৌধারি থেমে গিয়ে মুড়ির গামলার দিকে হাত বাড়ালেন। ঝাকানাকা বললেন, "দেখুন, পুলিশে চাকরি করেন ...[justify]গোয়েন্দা ঝাকানাকা একটি ভুরু উত্তোলন করে দারুণ এক অট্টহাসি দিলেন। দারোগা কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধারি গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। "কেস খুবই সরল।" ঝাকানাকা এক গাল মুড়ি চিবাতে চিবাতে বললেন। "বিষ্ণুমূর্তি আদৌ চুরি যায়নি।" কিংকু চৌধারি বললেন, "কিন্তু ...।" ঝাকানাকা চোখ পাকিয়ে তাকালেন শুধু। কিংকু চৌধারি থেমে গিয়ে মুড়ির গামলার দিকে হাত বাড়ালেন। ঝাকানাকা বললেন, "দেখুন, পুলিশে চাকরি করেন বলেই যে বুদ্ধু হতে হবে এমন কোন কথা নেই। ভাবুন মন দিয়ে। গোটা ব্যাপারটাকে দেখুন চোখের সামনে। শুধু একটা বাক্সকে নিয়ে চিন্তা করলেই তো হবে না। থিঙ্ক আউট অব দ্য বক্স!" কিংকু চৌধারি মুড়ি চিবাতে চিবাতে বললেন, "কিন্তু ...।" ঝাকানাকা বললেন, "কোন কিন্তু নাই। ঘটনা সরল। মূর্তি চুরি হয় নাই।" কিংকু চৌধারি আরেক খামচা মুড়ি নিলেন। ঝাকানাকা উঠে পড়লেন সোফা ছেড়ে। বললেন, "আপনাদের হাতে আসলে আছে কী? একটি ভিজা, স্ক্রু খোলা বাক্স, যার গায়ে যাদুঘরের সীল আছে। আর আছে কী? আছে অকুস্থল, বিমানবন্দরের পাশে একটা জলা, যেখানে আপনাদের লোকেরা লোক দেখিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করেছে। আর আছে কী? ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে আটক করা একটা ট্রাক, যার সীটের নিচে এক হালি বিষ্ণুমূর্তি।" কিংকু চৌধারি বললেন, "ঠিক!" ঝাকানাকা বললেন, "আর এগুলি থেকে আপনারা ভাবছেন বিষ্ণুমূর্তি চুরি হয়েছে। ভুল।" কিংকু চৌধারি বললেন, "কেন?" ঝাকানাকা বললেন চোখ পাকিয়ে, "ভাবুন! ভেবে দেখুন!" কিংকু চৌধারি মনমরা হয়ে আরেক খামচা মুড়ি তুলে নেন। "রাত দু'টো পর্যন্ত পুলিশ পাহারায় ছিলো এয়ারপোর্টে। তারপর তারা চলে যায়। কেন চলে যায়? কারণ তাদেরও তো ঈদ আছে। তারাও তো গরুর মাংস দিয়ে পোলাও খেতে চায়। বেশ। খাক। কিন্তু তারপর কী হলো? একটা বাক্স লোপাট হয়ে গেলো। হই হই রই রই। সেই বাক্স আবার খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না, ধারেকাছেই একটা জলায় তাকে পাওয়া গেলো। তার মাথার স্ক্রু খুলে পড়ে গেছে, ভেতরটা ফাঁকা। ... এখানে ভাবতে হবে, কেন? কেন বাক্সটা পাওয়া গেলো? বাক্সসুদ্ধুই কেন মূর্তিগুলি সরানো হয়নি?" কিংকু চৌধারি বললেন, "বারে, বাক্সসুদ্ধু নিলে ধরা পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকে না?" ঝাকানাকা বললেন, "তা থাকে। কিন্তু বাক্সের গা থেকে কাগজের লেবেলটা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেই কিন্তু ঝামেলা চুকে যেতো। বাক্স খুলে জিনিসটা বার করতে হতো না। আর এইসব মূর্তি খুব সাবধানে প্যাক করতে হয়। বাক্সের ভেতরে থাকলেই বরং জিনিসটা নিরাপদ থাকে। চোরও তা জানে। চোর জানে এই জিনিস গদাম করে গাড়ির বুটে ফেলে নেয়ার জিনিস নয়। সামান্য দাগদুগ পড়লেই কালোবাজারে এর দাম ফস করে নেমে আসবে একশো ভাগের এক ভাগে। তারপরও সে এতো কাঁচা কাজ করলো কেন?" কিংকু চৌধারি একটা পুলিশি হাসি দ্যান। বলেন, "আপনি ভুলে যাচ্ছেন স্যার! বাক্সসহ জিনিসটা লোপাট করতে গেলে এয়ারপোর্টের দুর্ধর্ষ সিকিউরিটির হাতে বমাল ধরা পড়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়!" ঝাকানাকা হাসেন। বলেন, "মুহাহাহাহাহাহা! তাই নাকি? তো বাক্স ছাড়া লোপাট করার সময় কি এয়ারপোর্টের দুর্ধর্ষ সিকিউরিটি ঘুমাচ্ছিলো?" কিংকু চৌধারির মুখটা কালো হয়ে যায়। তিনি আমতা আমতা করে বলেন, "হয়তো কোন কাপড়টাপড় দিয়ে ঢেকেঢুকে, কিংবা ব্যাগে ভরে ...।" ঝাকানাকা বলেন, "বাক্সটা টিভিতে দেখেছি। ওটাকেও তো কাপড়টাপড় দিয়ে ঢেকে নেয়া যেতো। কিংবা ব্যাগে ভরে। নিলো না কেন?" কিংকু চৌধারি বলেন, "দেখুন, এইসব চোরছ্যাঁচড়ের কারবার বোঝা বড় দায় ...।" ঝাকানাকা বলেন, "হুমম। আপনার আমার কাজই ওটা। ঐ দায় নিয়েই চলতে হবে। এখন ভাবুন। কেন বাক্সটা পাওয়া গেলো, একেবারে নাকের ডগায়?" কিংকু চৌধারি বলেন, "কেন?" ঝাকানাকা বলেন, "কারণ বাক্সটার নিয়তিই ছিলো ধরা পড়া। আশেপাশে কোথাও খালি পেট নিয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় ধরা পড়া।" কিংকু চৌধারি বলেন, "মানে?" ঝাকানাকা বলেন, "মানে হচ্ছে, সময়মতো যদি বাক্সটা সরিয়ে ফেলা না হতো, এবং স্ক্রু খুলে তাকে কোথাও ফেলে রাখা না হতো, তাহলে ওজন করার সময় এয়ার ফ্রান্সের লোকজন বুঝে ফেলতো যে বাক্সটা আসলেই খালি, ওর ভেতরে কোন মূর্তি ছিলো না। তখন তারা হাউকাউ শুরু করতো।" কিংকু চৌধারি বলেন, "মানে কী?" ঝাকানাকা হাসেন। বলেন, "যদি ধরে নেই, রাত দু'টোর পর, পুলিশ চলে যাবার পর বাক্স থেকে মূর্তি দুটো চুরি হয়েছে, তাহলে কিভাবে ভোরবেলা ভারত-নেপাল সীমান্তে চারটা বিষ্ণু পাওয়া যায়? ভুলে যাবেন না, গতরাতে ঘন কুয়াশা ছিলো দেশে। উত্তরাঞ্চলের রাস্তা এ সময় কুয়াশায় ছেয়ে থাকে। হাজার বড় তালেবর ড্রাইভারও ঘন্টায় ষাট কিলোমিটারের বেশি গতিতে ঐ রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারবে না। উত্তরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পার করতে গেলে অন্তত পক্ষে আট ঘন্টা লাগবে। সেখান থেকে ভারত নেপাল সীমান্ত আরো ঘন্টা তিনেকের রাস্তা। হিসাব তো মিলছে না।" কিংকু চৌধারি বলেন, "তাহলে?" ঝাকানাকা বলেন, "সম্ভাবনা দু'টো। এক, ঐ ট্রাকে যেসব বিষ্ণু আছে, সেগুলি আমাদের নয়। সেগুলি নকল বা অন্য বিষ্ণু। দুই, ঐ চারটার মধ্যে দু'টো আমাদের বিষ্ণুর রেপ্লিকা। তিন ...।" কিংকু চৌধারি বলেন, "আপনি না বললেন দু'টো সম্ভাবনা?" ঝাকানাকা বললেন, "চোপ! তিন, ঐ চারটার মধ্যে দু'টো আমাদের আসল বিষ্ণু।" কিংকু চৌধারি বলেন, "এখন?" ঝাকানাকা বললেন, "যদি এক বা দুই হয়, তাহলে হয়তো বিষ্ণু এয়ারপোর্ট থেকেই চুরি গেছে, এবং এই মূহুর্তে সে নিরাপদে চোরের আস্তানায় চলে গেছে। সেটা কোথায় বলতে গেলে অনেক লোককে খুব ভালোভাবে প্যাঁদাতে হবে। আর যদি তিন হয়, তাহলে এয়ারপোর্ট থেকে চুরি হয়নি, আমি যা ভাবছি তা-ই হয়েছে। যাদুঘর থেকে খালি বাক্স প্যাক করা হয়েছে। হোমবাউন্ডের গাড়ি পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ, কিন্তু কিছু হাতসাফাই তাদের পক্ষেও করা সম্ভব, কাজেই এমনও হতে পারে যে ভরা বাক্স মাঝপথে পাল্টে খালি বাক্স লোড করা হয়েছে এয়ারপোর্টে। ওদেরকেও প্যাঁদানোর লিস্টে রাখুন।" কিংকু চৌধারি বলেন, "খালি বাক্স?" ঝাকানাকা বললেন, "হুম। খালি বাক্স পাঠিয়ে বিষ্ণুদু'টোকে চুপিচুপি ছালার বস্তায় ভরে তুলে দেয়া হয়েছে দুপুরের দিকেই। তারা চলে গেছে সীমান্তের দিকে। সেখান থেকে রাতে তারা বাংলাদেশ ছেড়ে ঢুকে পড়েছে ভারতে।" কিংকু চৌধারি বলেন, "এখন হয়েছে কোনটা? এক, দুই না তিন?" ঝাকানাকা বলেন, "প্যাঁদাতে হবে, বুঝলেন, প্যাঁদালেই বেরিয়ে পড়বে সব গড়গড় করে। তিব্বতি উষ্টাটা কাজে লাগাতে হবে এবার ... এতো কষ্ট করে শিখলাম, কাজে লাগাতে পারিনা ...।" কিংকু চৌধারি বললেন, "দুই নাম্বার সম্ভাবনাটা বুঝি নাই। আমাদের বিষ্ণুর রেপ্লিকা কেন ধরা পড়বে নেপাল সীমান্তে?" ঝাকানাকা হাসেন। বলেন, "যে কারণে খালি বাক্স ফেরত এসেছে, সে কারণেই! রেপ্লিকা ফেরত আসবে, তারপর বিষ্ণুর জায়গা দখল করে বসে পড়বে যাদুঘরে।" কিংকু চৌধারি বলেন, "মানে? লোকজন বুঝে ফেলবে না?" ঝাকানাকা হাসেন। বলেন, "না। যারা বুঝবে তারা মুখ বুঁজে থাকবে হয়তো।" কিংকু চৌধারি বলেন, "কিন্তু ফ্রান্সের ওরা তো ঠিকই বুঝে ফেলবে!" ঝাকানাকা হাসেন। বলেন, "একবার চুরি যাবার পর কি আর ঐ জিনিস এতো সহজে আর ফ্রান্সে যাবে?" কিংকু চৌধারি বলেন, "আরেশশালা, তাই তো!" ঝাকানাকা বলেন, "মুড়ি খান।" কিংকু চৌধারি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকান ঝাকানাকার দিকে, গালি দিলো নাকি? . . . গোয়েন্দা ঝাকানাকা! | Promote Your Page Too | false |
ij | বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন-এর ‘অবরোধবাসিনী’ থেকে পাঠ (৪) বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন-এর (১৮৮০-১৯৩২) বিস্তারিত পরিচয় দেওয়া এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। তাঁর সম্বন্ধে আমরা কমবেশি জানি। তাঁর রচিত “অবরোধবাসিনী” বইটি আমাদের কারও কারও পড়া কিংবা কারও কারও এখনও পড়া হয়নি। এ কারণেই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন-এর অবরোধবাসিনী থেকে পাঠ-এর এই পরিকল্পনা। উদ্দেশ্য, একুশ শতকে বসে বেগম রোকেয়ার চিন্তার স্বরুপ উপলব্দি করা। [ ২১ ] বঙ্গদেশের কোন জমীদারের বাড়ী পুণ্যাহের উৎসব উপলক্ষে নাচ গান হইতেছিল। নর্ত্তকীরা বাহিরে যেখানে বিরাট শামিয়ানার নীচে নাচিতেছিল, সে স্থানটা বাড়ীর দেউড়ীর কামরা হইতে দেখা যাইত। কিন্তু বাড়ীর কোনও বিবি সে দেউড়ীর ঘরে যান নাই। নৃত্য দর্শন ও সঙ্গীত শ্রবণের সৌভাগ্য লইয়া বিবিরা ধরাধামে আসেন নাই। জমীদার সাহেবের একটী তিন বৎসর বয়স্কা কন্যা ছিল। মেয়েটী দিব্যি গৌরাঙ্গী। তাহাকে আদর করিয়া কেহ বলিত, চিনির পুতুল, কেহ বলিত, ননীর পুতুল। নাম সাবেরা। ভোরের সময় রৌশন চৌকির ভৈরবী আলাপে নিদ্রিত পাখীরা জাগিয়া কলরব আরম্ভ করিয়াছে। সাবেরার ‘খেলাই’ও (আধুনিক ভাষায় “আয়া”) জাগিয়া উঠিয়াছে। তাহার সাধ হইল, একটু নাচ দেখিতে যাইবে। কিন্তু সাবেরা তখনও ঘুমাইতেছিল। সুতরাং খেলাই সে নিদ্রিতা শিশুকে কোলে লইয়া ঘরে নাচ দেখিতে গেল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়! কর্ত্তা সেই সময় বহির্ব্বাটী হইতে অন্তঃপুরে আসিতেছিলেন। দেখিলেন, সাবেরাকে কোলে লইয়া খেলাই খড়খড়ির পাখী তুলিয়া তামাসা দেখিতেছিল। তাঁহার হাতে একটা মোটা লাঠি ছিল তিনি সেই লাঠি দিয়া খেলাইকে প্রহার আরম্ভ করিলেন। খেলাইয়ের চিৎকারে বিবিরা দৌড়িয়া দেউড়ী ঘরে আসিলেন। এক লাঠি লাগিল সাবেরার ঊরুতে। তখন কর্ত্তার ভ্রাতৃবন্ধু অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “ছোট সাহেব, করেন কি! করেন কি! মেয়ে মেরে ফেলবেন?” প্রহারবৃষ্টি তৎক্ষণাৎ থামিয়া গেল। জমীদার সাহেব সক্রোধে কহিলেন, “হতভাগী, নিজে নাচ দেখবি, দেখ না, কিন্তু আমার মেয়েকে দেখাতে আনলি কেন?” কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিশু ত খেলাইয়ের কাঁধে মাথা রাখিয়া গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল,-সে বেচারী কিছুই দেখে নাই। বাড়ীময় শোরগোল পড়িয়া গেল।-সাবেরার দুধের মত শাদা ধবধবে ঊরুতে লাঠির আঘাতে এক বিশ্রী কালো দাগ দেখিয়া কর্ত্তাও মরমে মরিয়া গেলেন। এইরূপে লাঠির গুতায় আমাদের অবরোধ-কারায় বন্দী করা হইয়াছে। [ ২২ ] শিয়ালদহ ষ্টেশনের প্লাটফরম ভরা সন্ধ্যার সময় এক ভদ্রলোকে ট্রেণের অপেক্ষায় পায়চারী করিতেছিলেন। কিছু দূরে আর একজন দাঁড়াইয়া ছিলেন; তাঁহার পার্শ্বে এক গাদা বিছানা ইত্যাদি ছিল। পূর্ব্বোক্ত ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ কান্তি বোধ করায় উক্ত গাদার উপর বসিতে গেলেন। তিনি বসিবা মাত্র বিছানা নড়িয়া উঠিল-তিনি তৎক্ষণাৎ সভয়ে লাফাইয়া উঠিলেন। এমন সময় সেই দণ্ডায়মান ভদ্রলোক দৌড়িয়া আসিয়া সক্রোধে বলিলেন,-“মশায়, করেন কি? আপনি স্ত্রীলোকদের মাথার উপর বসিতে গেলেন কেন?” বেচারা হতভম্ব হইয়া বলিলেন, “মাফ করিবেন, মশায়! সন্ধ্যার আঁধারে ভালমতে দেখিতে পাই নাই, তাই বিছানার গাদা মনে করিয়া বসিয়াছিলাম। বিছানা নড়িয়া উঠায় আমি ভয় পাইয়াছিলাম যে, এ কি ব্যাপার!” [ ২৩ ] অপরের কথা দূরে থাকুক। এখন নিজের কথা কিছু বলি। সবে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দ্দা করিতে হইত। ছাই কিছুই বুঝিতাম না যে, কেন কাহারও সম্মুখে যাইতে নাই; অথচ পর্দ্দা করিতে হইত। পুরুষদের ত অন্তঃপুরে প্রবেশ নিষেধ, সুতরাং তাহাদের অত্যাচার আমাকে সহিতে হয় নাই। কিন্তু মেয়েমানুষের অবাধ গতি-অথচ তাহাদের দেখিতে না দেখিতে লুকাইতে হইবে। পাড়ার স্ত্রীলোকেরা হঠাৎ বেড়াইতে আসিত; অমনি বাড়ীর কোন লোক চক্ষুর ইসারা করিত, আমি যেন প্রাণ-ভয়ে যত্র-তত্র-কখনও রান্নাঘরের ঝাঁপের অন্তরালে, কখনও কোন চাকরাণীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটীর অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোষের নীচে লুকাইতাম। বাচ্চাওয়ালী মুরগী যেমন আকাশে চিল দেখিয়া ইঙ্গিত করিবা মাত্র তাহার ছানাগুলি মায়ের পাখার নীচে পলায়, আমাকেও সেইরূপ পলাইতে হইত। কিন্তু মুরগীর ছানার ত মায়ের বুক স্বরূপ একটা নির্দিষ্ট আশ্রয় থাকে, তাহারা সেইখানে পলাইয়া থাকে; আমার জন্য সেরূপ কোন নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান ছিল না। আর মুরগীর ছানা স্বভাবতঃই মায়ের ইঙ্গিত বুঝে-আমার ত সেরূপ কোন স্বাভাবিক ধর্ম্ম (রহংঃরহপঃ) ছিল না। তাই কোন সময় চক্ষের ইসারা বুঝিতে না পারিয়া দৈবাৎ না পলাইয়া যদি কাহারও সম্মুখীন হইতাম, তবে হিতৈষিণী মুরুব্বিগণ, “কলিকালের মেয়েরা কি বেহায়া, কেমন বেগয়রৎ” ইত্যাদি বলিয়া গঞ্জনা দিতে কম করিতেন না। আমার পঞ্চম বর্ষ বয়সে কলিকাতা থাকাকালীন দ্বিতীয়া ভ্রাতৃবধূর খালার বাড়ী-বেহার হইতে দুইজন চাকরাণী তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছিল। তাহাদের ‘ফ্রী পাসপোর্ট’ ছিল,-তাহারা সমস্ত বাড়ীময় ঘুরিয়া বেড়াইত, আর আমি প্রাণ-ভয়ে পলায়মান হরিণশিশুর মত প্রাণ হাতে লইয়া যত্র-তত্র-কপাটের অন্তরালে কিম্বা টেবিলের নীচে পলাইয়া বেড়াইতাম। ত্রিতলে একটা নির্জ্জন চিল-কোঠা ছিল; অতি প্রত্যুষে আমাকে খেলাই কোলে করিয়া সেইখানে রাখিয়া আসিত; প্রায় সমস্ত দিন সেইখানে অনাহারে কাটাইতাম। বেহারের চাকরাণীদ্বয় সমস্ত বাড়ী তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিবার পর অবশেষে সেই চিল-কোঠারও বিপদের সংবাদ দিল। ভাগ্যে সেখানে একটা ছাপরখাট ছিল, আমি সেই ছাপরখাটের নীচে গিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া রহিলাম-ভয়, পাছে আমার নিঃশ্বাসের সাড়া পাইয়া সেই হৃদয়হীনা স্ত্রীলোকেরা খাটের নীচে উঁকি মারিয়া দেখে! সেখানে কতকগুলি বাক্স, পেটারা, মোড়া ইত্যাদি ছিল। বেচারা হালু, তাহার (৬ বৎসর বয়সের) ক্ষুদ্র শক্তি লইয়া সেইগুলি টানিয়া আনিয়া আমার চারিধারে দিয়া আমাকে ঘিরিয়া রাখিল। আমার খাওয়ার খোঁজখবরও কেহ নিয়মমত লইত না। মাঝে মাঝে হালু খেলিতে খেলিতে চিল-কোঠায় গিয়া উপস্থিত হইলে, তাহাকেই ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা বলিতাম। সে কখনও এক গ্লাস পানি, কখনও খানিকটা “বিন্নি” (খই বিশেষ) আনিয়া দিত। কখনও বা খাবার আনিতে গিয়া আর ফিরিয়া আসিত না-ছেলে মানুষ ত, ভুলিয়া যাইত। প্রায় চারিদিন আমাকে ঐ অবস্থায় থাকিতে হইয়াছিল। [ ২৪ ] বেহার অঞ্চলে শরীফ ঘরানার মহিলাগণ সচরাচর রেলপথে ভ্রমণের পথে ট্রেণে উঠেন না। তাঁহাদিগকে বনাতের পর্দ্দা ঢাকা পাল্কীকে পুরিয়া, সেই পাল্কীতে ট্রেণের মালগাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হয়। ফল কথা, বিবিরা পথের দৃশ্য কিছুই দেখিতে পান না। তাঁহারা ব্রুকবণ্ড চায়ের মত ঠধপঁঁস টিনে প্যাক হইয়া দেশ ভ্রমণ করেন। কিন্তু এই কলিকাতার এক ঘর সম্ভ্রান্ত পরিবার উহার উপরও টেক্কা দিয়াছেন। তাঁহাদের বাড়ীর বিবিদের রেলপথে কোথাও যাইতে হইলে প্রথমে তাঁহাদের প্রত্যেককে, পাল্কীতে বিছানা পাতিয়া, একটা তালপাতার হাত পাখা, এক কুজা পানি এবং একটা গ্লাস সহ বন্ধ করা হয়। পরে সেই পাল্কীগুলি তাঁহাদের পিতা কিম্বা পুত্রের সম্মুখে চাকরেরা যথাক্রমে-(১) বনাতের পর্দ্দা দ্বারা প্যাক করে; (২) তাহার উপর মোম-জমা কাপড় দ্বারা সেলাই করে; (৩) তাহার উপর খারুয়ার কাপড়ে ঘিরিয়া সেলাই করে; (৪) তাহার পর বোম্বাই চাদরের দ্বারা সেলাই করে; (৫) অতঃপর সর্ব্বোপরে চট মোড়াই করিয়া সেলাই করে। এই সেলাই ব্যাপার তিন চারি ঘণ্টা ব্যাপিয়া হয়-আর সেই চারি ঘণ্টা পর্য্যন্ত বাড়ীর কর্ত্তা ঠায় উপস্থিত থাকিয়া কাড়া পাহারা দেন। পরে বেহারা ডাকিয়া পাল্কীগুলি বনাতের পর্দ্দা ঢাকা অবস্থায় রাখিয়া চাকরেরা সরিয়া যায়। পরে কর্ত্তা স্বয়ং বন্দিনীদের অজ্ঞান অবস্থায় বাহির করিয়া যথারীতি মাথায় গোলাপজল ও বরফ দিয়া, মুখে চামচ দিয়া পানি দিয়া, চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়া বাতাস করিতে থাকেন। দুই ঘণ্টা বা ততোধিক সময়ের শুশ্রূষার পর বিবিরা সুস্থ হন। [ ২৫ ] “অবরোধ-বাসিনী”র ১১নং ঘটনায় লিখিয়াছি যে, আমি গত ১৯২৪ সনে আমার দুই নাতিনের বিবাহোপলক্ষে আরায় গিয়াছিলাম। কিন্তু আমি আরা শহরটায় সেই বাড়ীখানা এবং আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাই নাই। আমার “মেয়েকে” (অর্থাৎ মেয়ের মৃত্যুর পর জামাতার দ্বিতীয় পরে স্ত্রীকে) সেই কথা বলায় তিনি অতি মিনতি করিয়া আমাকে বলিলেন, “আম্মা, আপনি যদি দয়া করিয়া শহর দেখিতে চান, তবে আমরাও আপনার জুতার বরকতে শহরটা একটু দেখিয়া লইব। আমরা সাত বৎসর হইতে এখানে আছি, কিন্তুু শহরের কিছুই দেখি নাই।” সদ্যপরিণীতা মজু এবং সবুও সকাতরে বলিল, “হ্যাঁ নানি আম্মা, আপনি আব্বাকে বলিলেই হইবে।” আমি ক্রমান্বয়ে কয়েকদিন বাবাজীবনকে একখানা গাড়ী সংগ্রহ করিয়া দিতে বলায়, তিনি প্রতিদিনই অতি বিনীতভাবে জানাইতেন যে গাড়ী পাওয়া যায় না। শেষের দিন বিকালে তাঁহার ১১ বৎসর বয়স্ক পুত্র আমাদের সংবাদ দিল যে যদি বা একটা ভাড়াটে গাড়ী আসিয়াছে। কিন্তু তাঁহার জানালার একটা পাখী ভাঙ্গা। মজু অতি আগ্রহের সহিত বলিল, “সেখানটায় আমরা পর্দ্দা করিয়া লইব-আল্লার ওয়াস্তে তুমি গাড়ী ফেরত দিও না।” সবু ফিস্ফিস্ করিয়া বলিল, “ভালই হইয়াছে, ঐ ভাঙ্গা জানালা দিয়া ভালমতে দেখা যাইবে।” আমরা যতবারই গাড়ীতে উঠিতে যাইবার জন্য তাড়া দিই, ততবারই শুনিঃ সবুর করুন, বাহিরে এখনও পর্দ্দা হয় নাই। কিছুণ পরে গাড়ীতে উঠিতে দিয়া দেখি, সোবহান আল্লাহ! দুই তিন খানা বোম্বাই চাদর দিয়া গাড়ীটি সম্পূর্ণ ঢাকিয়া ফেলা হইয়াছে। জামাতা স্বয়ং গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিলেন, আমরা গাড়ীতে উঠিবার পর তিনি স্বহস্তে কাপড় দিয়া দরজা বাঁধিয়া দিলেন। গাড়ী কিছু দূরে গেলে, মজু সবুকে বলিল, “দেখ এখন ভাঙ্গা জানালা দিয়া!” সেই পর্দ্দার এক স্থলে একটা ছিদ্র ছিল, মজু, সবু এবং তাহাদের মাতা সেই দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিতে লাগিলেন, আমি আর সে ফুটা দিয়া দেখিবার জন্য তাহাদের সহিত কাড়াকাড়ি করিলাম না। [ ২৬ ] আমাদের ন্যায় আমাদের নামগুলি পর্য্যন্ত পর্দ্দানশীল। মেয়েদের নাম জানা যায়, কেবল তাহাদের বিবাহের কাবিন লিখিবার সময়। এক মস্ত জমীদারের তিন কন্যার বিবাহ একই সঙ্গে হইতেছিল। মেয়েদের ডাকনাম বড় গেন্দলা, মেজো গেন্দলা, এবং ছোট গেন্দলা-প্রকৃত নাম কেহই জানে না। তাহাদের সম্পর্কের এক চাচা হইলেন বিবাহ পড়াইবার মোল্লা। কন্যাদের বয়স অনুসারে তিন জল বরের বয়সেরও তারতম্য ছিল। তিন জন বরই বিবাহ কেন্দ্রে অনুপস্থিত। আমরা পাঠিকাদের সুবিধার নিমিত্ত বরদিগকে বয়স অনুসারে ১নং, ২নং এবং ৩নং বলিব। মোল্লা সাহেবের হাতে তিন বর এবং তিন কন্যার নামের তালিকা দেওয়া হইয়াছে। তিনি যথাসময় বিবাহের মন্ত্র পড়াইতে বসিয়া ভ্রমণবশতঃ বর ও কন্যাদের নাম গোলমাল করিয়া ১নং বরের সহিত ছোট গেন্দলার বিবাহ দিয়া দিলেন; ৩নং বরের সহিত মেজো গেন্দলার বিবাহ দিলেন। এখন ২নং বরের সহিত বড় গেন্দলার বিবাহের পালা। মেজো ও ছোট গেন্দলার বয়স খুব অল্প-১১ এবং ৭ বৎসর, তাই তাহারা কোন উচ্চ বাচ্য করে নাই। কিন্তু বড় গেন্দলার বয়স ১৯ বৎসর; সে লুকাইয়া ছাপাইয়া মুরুব্বিদের কথাবার্ত্তা শুনিয়া জানিয়াছিল, তাহার বিবাহ হইবে, ১নং বরের সহিত। আর বরের নামও তাহার জানা ছিল। সুতরাং ২নং বরের নাম লইয়া মোল্লা সাহেব যখন বড় গেন্দলার “এজেন” চাহিলেন, সে আর কিছুতেই মুখ খোলে না। মা, মাসীর উৎপীড়ন সহ্য করিয়াও সাহেবকে বলিলেন, “হাঁম গেন্দলা হুঁ বলেছে; বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি আর কতকণ হয়রাণ হবে।” তিনি বলিলেন, “আমরা গেন্দলার মুখের “হুঁ” শুনি নাই, তবে কি আপনার “হুঁ” লইয়া আপনারই বিবাহ পড়াইব নাকি?” তদুত্তরে ক’নের মা তাঁহার পিঠে এক বিরাট কিল বসাইয়া দিলেন। অবশেষে গেন্দলা বেচারী “হুঁ” বলিল কিনা আমরা সে খবর রাখি না। এদিকে যথাসময়ে টেলিগ্রাফযোগে ৩০ বৎসর বয়স্ড়্গা ১নং বর যখন জানিলেন যে, তাঁহার বিবাহ হইয়াছে, (১৯ বৎসর বয়স্কা বড় গেন্দলার পরিবর্ত্তে) সর্ব্বকনিষ্ঠা ৭ম বর্ষীয়া ছোট গেন্দলার সহিত তখন তিনি চটিয়া লাল হইলেন-শাশুড়ীকে লিখিলেন কন্যা বদল করিয়া দিতে; নচেৎ তিনি তাঁহার বিরুদ্ধে জুয়াচুরির মোকদ্দমা আনিবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। [ ২৭ ] প্রায় ১০/১১ বৎসরের ঘটনা। বলিয়াছি ত বেহার অঞ্চলে বিবাহের তিন মাস পূর্ব্বে “মাইয়া-খানায়” বন্দী করিয়া মেয়েদের আধমরা করা হয়। ও তখনও ঐ বন্দিশালায় বসিবার মেয়াদ,-যদি বাড়ীতে কোন দুর্ঘটনা হইয়া বিবাহের তারিখ পিছাইয়া যায় তবে-বৎসর কালও হয়; এক বেচারী সেইরূপ ছয়মাস পর্য্যন্ত বন্দিনী ছিল। তাহার স্নান, আহার প্রভৃতির বিষয়েও যথাবিধি যতœ লওয়া হইত না। একেই ত বেহারী লোকেরা সহজে স্নান করিতে চায় না, তাহাতে আবার “মাইয়াখানা”র বন্দিনী মেয়েকে কে ঘন ঘন স্নান করাইবে? ঐ সময় মেয়ে মাটিতে পা রাখে না-প্রয়োজনমত তাহাকে কোলে করিয়া স্নানাগারে লইয়া যাওয়া হয়। তাহার নড়াচড়া সম্পূর্ণ নিষেধ। সমস্ত দিন মাথা গুঁজিয়া একটা খাটিয়ার উপর বসিয়া থাকিতে হয়; রাত্রিকালে সেইখানেই শুইতে হয়। অপরে মুখে তুলিয়া ভাতের গ্রাস খাওয়ায়, অপরে “আবখোয়া” ধরিয়া পানি খাওয়াইয়া দেয়। মাথার চুলে জটা হয়, হউক-সে নিজে মাথা আঁচড়াইতে পাইবে না-ফল কথা, প্রত্যেক বিষয়ের জন্য তাহাকে পরের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হয়। যাহা হউক, ছয় মাস অন্তর সেই মেয়েটীর বিবাহ হইলে দেখা গেল, সর্ব্বদা চক্ষু বুজিয়া থাকার ফলে তাহার চক্ষু দুইটী চিরতরে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। [ ২৮ ] বহুকালের ঘটনা। বহু পুণ্যফলে আরবদেশীয় কোন মহিলা কলিকাতায় তশরীফ আনিয়াছেন। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দ্দু বলিতে শিখিয়াছিলেন। যখন দলে দলে বিবিরা পাল্কীযোগে তাঁহার জেয়ারত করিতে আসিতেন, তিনি পাল্কী দেখিয়া হয়রাণ হইতেন যে এ “আজাব” কেন? একদিন পূর্ব্ববঙ্গের এক বিবি আসিয়াছিলেন। আরবীয়া মহিলা কুশল প্রশ্ন প্রসঙ্গে আগন্তুক বিবির স্বামীর কুশল জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর দান কালে বাঙ্গাল বিবি মাথার ঘোমটা টানেন আর বলেন, “তানি ত বালই আছেন, তানার আবার কি অনব? তানি ত বালই আছেন।” বেচারী আরবীয়া বিবি বুঝিতেই পারিলেন না যে, স্বামীর কুশল বলিবার সময় ঘোমটা টানার প্রয়োজন হইল কেন? আরবীয়া বিবি বাঙ্গালায় বিবিদের পাল্কীতে উঠা ব্যাপারটা কৌতুকের সহিত দাঁড়াইয়া দেখিতেন। একদিন এক বোরকা পরিহিতা বিবি পাল্কীতে উঠিলেন, তাঁহার কোলে দুই বৎসরের শিশু, সঙ্গে পানদান, একটা বড় কাঠের বা, একটা কাপড়ের গাঁটরী এবং এক কূজা পানি। পাল্কীটার বেতের ছাউনি ভাঙ্গা ছিল, তাহা পূর্ব্বে কেহ লক্ষ্য করে নাই পাল্কীর দুই পার্শ্বে তুলিল, অমনি মড়মড় করিয়া পাল্কীর বেত্রাসন ভাঙ্গিতে লাগিল। পাল্কীর দুই পার্শ্বে দুই বরকন্দাজ চলিয়াছে-তাঁহারা শিশুটিকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সাহেবজাদা মড়মড় শব্দ করে কি?” কিন্তু পাল্কী হইতে কোন উত্তর আসিল না;- একটু পরে গেট পার হইয়া পাল্কীটা অত্যন্ত হালকা বোধ হওয়ায় বেহারাগণ থমকিয়া দাঁড়াইল। ওদিকে ভাঙ্গা পাল্কী গলাইয়া বোরকা পরা বিবি ছেলেকে আঁকড়িয়া ধরিয়া মাটীতে বসিয়া পড়িয়াছেন; গাঁটরী, পানদান সব ইতস্ততঃ বিপ্তি। কূজা ভাঙ্গিয়া পানি পড়িয়া তিনি ভিজিয়া গিয়াছেন,-কিন্তু তবু মুখে বলেন নাই-“পাল্কী থামাও!” কলিকাতার রাস্তায় এই ব্যাপার!-বেচারী আরবের বিবি তাড়াতাড়ি চাকরাণী পাঠাইয়া বিবিটীকে আনাইয়া বলিলেন, “বিবি, পাল্কীর এমন তামাসা দেখিবার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না!” [ ২৯ ] একবার আমি কোন একটী লেডীজ কনফারেন্স উপলক্ষে আলীগড়ে গিয়াছিলাম। সেখানে অভ্যাগতা মহিলাদের নানাবিধ বোরকা দেখিলাম। একজনের বোরকা কিছু অদ্ভুত ধরণের ছিল। তাঁহার সহিত আলাপ পরিচয়ের পর তাঁহার বোরকা প্রশংসা করায় তিনি বলিলেন,-“আর বলিবেন না,-এই বোরকা লইয়া আমার যত লাঞ্ছনা হইয়াছে!” পরে তিনি সেই সব লাঞ্ছনার বিষয় যাহা বলিলেন, তাহা এইঃ তিনি কোন বাঙ্গালী ভদ্রলোকের বাড়ী শাদীর নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন। তাঁহাকে (বোরকা সহ) দেখিবামাত্র সেখানকার ছেলে-মেয়েরা ভয়ে চীৎকার করিয়া কে কোথায় পলাইবে, তাহার ঠিক নাই। আরও কয়েক ঘর বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সহিত তাঁহার স্বামীর আলাপ ছিল, তাই তাঁহার সকলেল বাড়ীই যাইতে হইত। কিন্তু যতবার যে বাড়ী গিয়াছেন, ততবারই ছেলেদের সভয় চীৎকার ও কোলাহল সৃষ্টি করিয়াছেন। ছেলেরা ভয়ে থরথর কাঁপিত। তিনি একবার কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। তাঁহারা চারি পাঁচ জনে বোরকাসহ খোলা মোটরে বাহির হইলে পথের ছেলেরা বলিত, “ওমা! ওগুলো কি গো?” একে অপরকে বলে “চুপ কর!-এই রাত্রিকালে ওগুলো ভূত না হয়ে যায় না।” বাতাসে বোরকার নেকার একটু আধটু উড়িতে দেখিলে বলিত-“দেখবে দেখ। ভূতগুলো শুঁড় নড়ে-! বাবারে! পালা রে!” তিনি এক সময় দার্জ্জীলিং গিয়াছিলেন। ঘুম ষ্টেশনে পৌঁছিলে দেখিলেন, সমবেত জনমণ্ডলী একটা বামন লোককে দেখিতেছে-বামনটা উচ্চতায় একটা ৭/৮ বৎসরের বালকের সমান, কিন্তু মুখটা বয়োপ্রাপ্ত যুবকের,-মুখভরা দাড়ী গোঁফ। হঠাৎ তিনি দেখিলেন, জনমণ্ডলীর কৌতূকপূর্ণ দৃষ্টি তাঁহার দিকে! দর্শকেরা সে বামন ছাড়িয়া এই বোরকাধারিণীকে দেখিতে লাগিল! অতঃপর দার্জ্জিলিং পৌঁছিয়া তাঁহারা আহারান্তে বেড়াইতে বাহির হইলেন; অর্থাৎ রিকশ গাড়ীতে করিয়া যাইতেছিলেন। “মেলে” গিয়া দেখিলেন, অনেক লোকের ভীড়; সেদিন তিব্বত হইতে সেনা ফিরিয়া আসিতেছিল, সেই দৃশ্য দেখিবার জন্য ভীড়। তাঁহার রিকশখানি পথের একধারে রাঁখিয়া তাঁহার কুলিরাও গেল,-তামাসা দেখিতে। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি দেখেন, দর্শকেরা সকলেই এক একবার রিকশর ভিতর উঁকি মারিয়া তাঁহাকে দেখিয়া যাইতেছে। তিনি পদব্রজে বেড়াইতে বাহির হইলে পথের কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিত। দুই একটা পার্ব্বত্য ঘোড়া তাঁহাকে দেখিয়া ভয়ে সওয়ার শুদ্ধ লাফালাফি আরম্ভ করিত। একবার চায়ের বাগানে বেড়াইতে গিয়া দেখেন, তিনি চারি বৎসরের এক বালিকা মস্ত ঢিল তুলিয়াছে, তাঁহাকে মারিতে!* একবার তাঁহার পরিচিতা আরও চারি পাঁচজন বিবির সহিত বেড়াইবার সময় একটা ক্ষুদ্র ঝরণার ধারে কঙ্করবিশিষ্ট কাদায় সকলেই বোরকায় জড়াইয়া পড়িয়া গেলেন। নিকটবর্ত্তী চা বাগান হইতে কুলিরা দৌড়িয়া আসিয়া তাঁহাদের তুলিল; আর স্নেহপূর্ণ ভৎর্সনায় বলিল, “একে ত জুত্তা পরেছ, তার উপর আবার ঘেরাটোপ,-এ অবস্থায় তোমরা গড়াইবে না ত কি করিবে?” আহা! বিবিদের কারচুপি কাজ করা দো-পাট্রা কাদায় লতড়-পতড়, আর বোরকা ভিজিয়া তর-বতর! কেবল ইহাই নহে, পথের লোক রোরুদ্যমান শিশুকে চুপ করাইবার নিমিত্ত তাঁহাদের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বলিত,-“চুপ কর, ঐ দেখ মক্কা মদিনা যায়,-ঐ!”-ঘেরাটোপ জড়ানো জুজুবুড়ী,-ওরাই মক্কা মদিনা!!” * বাঙ্গালী ও গুর্খায় প্রভেদ দেখুন; যৎকালে বাঙ্গালী ছেলেরা ভয়ে চীৎকার করিয়া দৌড়াদৌড়ি করিয়া পলাইত, সে সময় গুর্খাশিশু আত্মরক্ষার জন্য ঢিল তুলিয়াছে সে ভয়াবহ বস্তুকে মারিতে! [ ৩০ ] কোন একটী কুলে শীলে ধন্য সৎ পাত্রের সহিত এক জমীদারের বয়োপ্রাপ্তা কন্যার বিবাহ ঠিক হইয়াছিল। কি কারণে বরের পিতার সহিত কন্যাকর্ত্তার ঝগড়া হওয়ায় বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল। ইহাতে পাত্রী যাহার পর নাই দুঃখিতা হইল। কন্যার পিতা তাড়াতাড়ি অন্য বর না পাইয়া নিজের এক দুরাচার ভ্রাতুস্পুত্রের সহিত কন্যার বিবাহ দিতে বসিলেন। সে বেচারী তাহার খুড়তাতো ভাইয়ের কুকীর্ত্তির বিষয় সমস্তই অবগত ছিল,-কত দিন সে নিজেই ঐ মাতালটাকে তেঁতুলের শরবত খাওয়াইয়া এবং মাথায় জল ঢালিয়া তাহার মাতলামী দূর করিতে চেষ্টা করিয়াছে। সুতরাং এ বিবাহে তাহার ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু পাত্রী ত মূক,-তাহার বাকশক্তি থাকিয়াও নাই। তাহার একমাত্র সম্বল নীরব রোদন। তাই সে কেবল কাঁদিয়া চক্ষু ফুলাইয়াছে, আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়াছে। কিন্তু নিষ্ঠুর পিতামাতার ভ্রক্ষেপ নাই,-তাঁহারা ঐ মাতালের সহিত তাহার বিবাহ দিবেনই দিবেন। এইরূপেই আমাদের কাঠমোল্লা মুরুব্বিগণ শরিয়তের গলা টিপিয়া মারিয়া ইসলাম ও শরিয়ত রক্ষা করিতেছে। বিবাহ-সভায় বসিয়া পাত্রী কিছুতেই “হুঁ” বলিতেছিল না। মাতা, পিতামহী প্রভৃতির অনুনয়, সাধ্য-সাধনা, মিষ্ট র্ভৎসনা,-সবই সে দুই চরে জলে ভাসাইয়া দিতেছিল। অবশেষে একজনে অতর্কিতে কন্যাকে খুব জোরে চিমটি কাটিল; সেই আঘাতে সহসা “উহু-!” বলিয়া সে কাতর ধ্বনি করিয়া উঠিল। সেই “উহু” কে “হুঁ” বলিয়া ধরিয়া লইয়া তাহার বিবাহ ক্রিয়া সমাপ্ত হইল। সোবহান আল্লাহ্! জয়, অবরোধের জয়! ক্রমশ ... সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৮:১৮ | false |
fe | "লন্ডন-নিউইয়র্কে রমরমা যাদু টোনা ব্যব(...TRUNCATED) | false |
ij | "Gnostic সংঘের ইতিবৃত্ত সময়টা খ্রিষ্টীয় প্(...TRUNCATED) | false |
rn | "পেটের চর্বি কমানোর পাঁচটি ব্যায়াম ১. (...TRUNCATED) | false |
Description
BAAD6 is an Authorship Attribution dataset for Bengali Literature. It was collected and analyzed by Hemayet et al [1]. The data was obtained from different online posts and blogs. This dataset is balanced among the 6 Authors with 350 sample texts per author. This is a relatively small dataset but is noisy given the sources it was collected from and its cleaning procedure. Nonetheless, it may help evaluate authorship attribution systems as it resembles texts often available on the Internet. Details about the dataset are given in the table below.
Author | Samples | Word count | Unique word |
---|---|---|---|
fe | 350 | 357k | 53k |
ij | 350 | 391k | 72k |
mk | 350 | 377k | 47k |
rn | 350 | 231k | 50k |
hm | 350 | 555k | 72k |
rg | 350 | 391k | 58k |
Total | 2,100 | 2,304,338 | 230,075 |
Average | 350 | 384,056.33 | 59,006.67 |
Citation
If you use this dataset, please cite the paper A Comparative Analysis of Word Embedding Representations in Authorship Attribution of Bengali Literature.
@INPROCEEDINGS{BAAD6Dataset,
author={Ahmed Chowdhury, Hemayet and Haque Imon, Md. Azizul and Islam, Md. Saiful},
booktitle={2018 21st International Conference of Computer and Information Technology (ICCIT)},
title={A Comparative Analysis of Word Embedding Representations in Authorship Attribution of Bengali Literature},
year={2018},
volume={},
number={},
pages={1-6},
doi={10.1109/ICCITECHN.2018.8631977}
}
This dataset is also available in Mendeley: BAAD6 dataset. Always make sure to use the latest version of the dataset. Cite the dataset directly by:
@misc{BAAD6Dataset,
author = {Ahmed Chowdhury, Hemayet and Haque Imon, Md. Azizul and Khatun, Aisha and Islam, Md. Saiful},
title = {BAAD6: Bangla Authorship Attribution Dataset},
year={2018},
doi = {10.17632/w9wkd7g43f.5},
howpublished= {\url{https://data.mendeley.com/datasets/w9wkd7g43f/5}}
}
- Downloads last month
- 61